সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০১৮-২০১৯ সেশনের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের নীল প্যানেল। অন্যদিকে, ভরাডুবি হয়েছে সরকার সমর্থিত আইনজীবীদের সাদা প্যানেলের। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও দলটির সমর্থকদের এমন ভরাডুবির নেপথ্যে বেশ কিছু রাজনৈতিক ভুল সিদ্বান্তকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।
এবারের নির্বাচনে আইনজীবী ভোটাররা দুটি বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে একটি ছিল সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার পদত্যাগ। আর দ্বিতীয়টি আপিল বিভাগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আটকে দেওয়ার প্রসঙ্গ।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলায় আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশের পর এসকে সিনহার কিছু পর্যবেক্ষণ নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন সরকার সমর্থিত মন্ত্রী, এমপি ও নেতারা। একইসঙ্গে তার পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়ে ওঠেন সুপ্রিম কোর্টের আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর রায় ও পর্যবেক্ষণের পর থেকেই এসকে সিনহার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে আসছিলেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা।
এস কে সিনহার বিরুদ্ধাচারণ আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের ভরাডুবির প্রধান কারণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সভাপতি সুব্রত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার পদত্যাগের বিষয়ে সরকার ও তার সমর্থিত আইনজীবীরা যে বিরূপ ভূমিকা রেখেছিল, তা সাধারণ আইনজীবীদের কাছে পছন্দনীয় বা গ্রহণযোগ্য ছিলো না। এছাড়াও নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাতে রেখে তাদের চাকরির যে শৃঙ্খলা বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে, তাও আইনজীবীরা সহজভাবে নেননি। এসব কারণেই তারা আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের ভোট দেননি।’
প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০১৮-২০১৯ সেশনের নির্বাচনে সভাপতি পদে বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেল থেকে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ৫৪ ভোট বেশি পেয়ে আবারও বিজয়ী হয়েছেন। তার প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ২ হাজার ৩৬৯টি। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাদা প্যানেলের অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। তার প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ২ হাজার ৩১৫টি। এছাড়া সম্পাদক পদে নীল প্যানেলের ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন ৪৪১ ভোট বেশি পেয়ে টানা ষষ্ঠ বারের মতো বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাদা প্যানেলের অ্যাডভোকেট এস কে মো. মোরসেদ।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্ট পরিষদের সদস্য ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, ‘সভাপতি ও সম্পাদক পদে বিজয়ী আর পরাজিত প্রার্থীদের ভোটের ব্যবধান খুবই কম ছিল। অন্যান্য পদে কী হলো জানি না!’ তিনি দাবি করেন, ‘আমার যতদূর মনে হচ্ছে, বিচারপতি এসকে সিনহার প্রসঙ্গে আইনজীবীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যার কারণে একশ‘র মতো ভোট এদিক-ওদিক হয়েছে। আর এই ভোটের কারণেই সাদা প্যানেলের পরাজয় হয়েছে।’
তবে বিচারপতি এসকে সিনহার পদত্যাগের প্রসঙ্গটি ছাড়াও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন আপিল বিভাগে আটকে দেওয়ার পেছনে যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল, তার প্রতিবাদ জানাতে সাধারণ আইনজীবীরা বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেলকে জয়যুক্ত করেছে বলে দাবি করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদ্য নির্বাচিত সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন।
খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন আপিল বিভাগে স্থগিত করাটাকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের পরাজয়ের তৃতীয় কারণ বলেও মনে করেন অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছরের সাজার মামলায় কনিষ্ঠ আইনজীবীরা শুনানি করলেই হাইকোর্ট জামিন দিয়ে দেন। তবুও হাইকোর্ট তাকে জামিন দিলো, কিন্তু আদেশ একটু ঘুরিয়ে দিলো। এরপর সেই আদেশের ওপর আপিল বিভাগ আবার হস্তক্ষেপ করলো। এর ফলে খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়ে যে ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, তা আইনজীবীরা পছন্দ করেননি।’
অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘বিচার বিভাগের ওপর সরকার যে হস্তক্ষেপ করছে, এটা মানুষ পছন্দ করে না। আর প্রধান বিচারপতিকে (এসকে সিনহা) তারা যেভাবে বিদায় দিয়েছেন, সেটাও যথাযথ হয়নি। তারপর তারা মাসদার হোসেন মামলা নিয়ে গেজেট (অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা) করেছে, এটাও মানুষ পছন্দ করেনি। শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার জামিনকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তাতে মনে হচ্ছে— বিচার বিভাগ সরকারের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা আমাদের নির্বাচিত করেছে। দেশের কোথাও যে গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোটাধিকার নেই, আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটেছে।’
উল্লেখ্য, বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেলে থেকে সভাপতি ও সম্পাদক ছাড়াও সহ-সভাপতি পদে ড. মো. গোলাম রহমান ভূঁইয়া ও এম. গোলাম মোস্তফা, কোষাধ্যক্ষ নাসরিন আক্তার, সহ-সম্পাদক কাজী জয়নুল আবেদীন, সদস্য পদে মাহফুজ বিন ইউসুফ, সাইফুর আলম মাহমুদ, মো. আহসান উল্লাহ ও মোহাম্মদ মেহেদী হাসান বিজয়ী হয়েছেন।
অন্যদিকে সাদা প্যানেল থেকে সহ-সম্পাদক পদে মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক, সদস্য ব্যারিস্টার আশরাফুল হাদী, শাহানা পারভীন ও শেখ মোহাম্মদ মাজু মিয়া জয়লাভ করেছেন।
সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন