পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতারাও বাধ্য হয়ে ভাড়া করছেন ক্যাডার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না পুলিশ গণতন্ত্রের কোণঠাসা দশার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আস্থা সংকটে পড়ার শঙ্কা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর দেশের রাজনীতিতে অপরাধ জগতের ডন ও তাদের সহযোগীদের কদর প্রায় শূন্যের কোটায় এসে ঠেকলেও এ ধারায় ফের উল্টো শ্রোত বইতে শুরম্ন করেছে। বিশেষ করে জাতীয় একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেকেই এখন পেশাদার সন্ত্রাসীদের দলে ভিড়ানোর চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এদের কেউ কেউ আবার কারাবন্দি গডফাদারদের জামিনে মুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ অবস্থায় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার মাঠ ও ভোটের দিনের নিরাপত্তা নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাঝেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়াচ্ছে।
এদিকে জাতীয় রাজনীতিতে ফের সন্ত্রাসীদের কদর বাড়ার বিষয়টি অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন। তাদের ভাষ্য, রাজনীতিতে গণতন্ত্রের ঘোর সংকট দেখা দেয়ায় ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল দু'পক্ষই 'ক্যাডার পলিটিক্সে' ঝুঁকেছে। প্রভাবশালী নেতারা জনসমর্থন ছাড়াই শুধু পেশিশক্তিতে নির্বাচনী বিজয় ছিনিয়ে আনতে চাইছে। রাজনীতিতে গণতন্ত্রের কোণঠাসা দশা সহসাই না কাটলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে এ পালস্না আরও জোরদার হবে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে খুনোখুনি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন রাজনৈতিক বিশেস্নষকরা।
গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে জানান, গত বছরের শেষভাগ থেকে আকস্মিক সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক দলে ভেড়ানোর তৎপরতা বাড়ছে। এমনকি ক্যাডার পলিটিক্স থেকে পুরোপুরি দূরে থাকা ক্লিন ইমেজের নেতারাও এখন একই পথে এগোচ্ছেন, যা তাদের জন্য চরম উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি তারা শীর্ষ প্রশাসনকেও অবহিত করেছেন।
এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেক প্রার্থীই দলে পেশাদার সন্ত্রাসীদের ভেড়ানোর কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করলেও ক্লিন ইমেজের কেউ কেউ তা স্বীকার করেছেন। তাদের ভাষ্য, দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা পুরোপুরি উঠে যাওয়ায় সবাই এখন 'বিজয় মুকুটকে' সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছেন। আর তা অর্জনের জন্য যে কোনো ধরনের নোংরামিতে জড়াচ্ছেন। পরিস্থিতি বর্তমানে এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী ছাড়া নির্বাচনে জয়লাভ দূরে থাক, প্রচার-প্রচারণা চালানোও হয়তো সম্ভব হবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন ক্লিন ইমেজের একাধিক রাজনীতিক নেতা।
ঢাকার একটি আসনের একজন সম্ভাব্যপ্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধ জগতের ডন থেকে মাত্র কয়েক বছর আগে রাজনীতির খাতায় নাম লেখানো তার দলেরই একজন নেতা নিজেই নিজেকে দলীয় প্রার্থী দাবি করে আগাম নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। তার ক্যাডাররা এলাকায় নিয়মিত অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। অথচ দলের অন্য নেতারা ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন। এ অবস্থায় তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে প্রতিপক্ষও দলে সন্ত্রাসীদের টানছেন। শুধু এ আসনেই নয়, ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ আসনে একই পরিবেশ-পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে দাবি করেন ওই নেতা।
তার এ দাবি যে অমূলক নয়, সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার বিপুল সংখ্যক মাঠকর্মকর্তারা নিঃসংকোচে তা স্বীকার করেন। তারা জানান, আওয়ামী লীগ প্রথম টার্মে ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতিতে সন্ত্রাসীদের কদর কমতে শুরম্ন করে। যা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর দ্রম্নত শূন্যের কোটায় এসে ঠেকে। এ পরিস্থিতিতে অপরাধ জগতের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে শীর্ষসন্ত্রাসীদের অনেকেই তাদের সহযোগীদের নিয়ে দলেবলে রাজনীতির খাতায় নাম লেখান। তাদের কেউ কেউ আবার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের গুরম্নত্বপূর্ণ পদও বাগিয়ে নেন। যাদের বেশিরভাগই এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই একই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী অপর নেতারাও দলে সন্ত্রাসী বহর বাড়ানোর দিকে ঝুঁকেছেন।
ঢাকার বাইরের একাধিক জেলার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, রাজনৈতিক দলে নতুন করে সন্ত্রাসীদের কাছে টানার প্রবণতা এতটাই বেড়েছে যে, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের যাকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করছে, তাকেই কোনো না কোনো নেতা নিজ দলের কর্মী হিসেবে দাবি করছেন। অথচ একই দলের প্রতিপক্ষ নেতা ওই সন্ত্রাসীদের অপরাধমূলক কর্মকা-ের ফিরিস্ত্মি পুলিশের কাছে তুলে ধরছেন। ক্ষমতাসীন দলের দু'নেতার দু'ধরনের বক্তব্যে পুলিশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছে বলে দাবি করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
এদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সন্ত্রাসীদের কদর বাড়ার বিষয়টি তারা নিজেরাও অনেকে স্বীকার করেছেন। বিদেশে আত্মগোপনে থাকা রাজধানীর একজন শীর্ষসন্ত্রাসীর প্রধান সহযোগী জানান, ক্ষমতাসীন দলের একই আসনের একাধিক নেতা তাদের হয়ে কাজ করার জন্য 'অফার' দিয়েছেন। তবে তারা সবদিক ভেবেচিন্ত্মে যে কোনো একজনের পক্ষ নেবেন। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালানোর কাজে সম্পৃক্ত থাকার কথা বলে তাদের দলে টানার প্রস্ত্মাব দেয়া হলেও তাদেরকে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে পেশিশক্তিতে দমিয়ে রাখার জন্যই নেয়া হচ্ছে বলে স্বীকার করেন সন্ত্রাসী দলের ওই সেকেন্ড-ইন-কমান্ড।
অপরাধ জগতের অপর একটি সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ায় আত্মগোপনে থাকা গুলশান এলাকার একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ক্ষমতাসীন দলের একজন সম্ভাব্যপ্রার্থী নানাভাবে চেষ্টা তদবির চালাচ্ছেন। এরইমধ্যে তার বেশ ক'জন সহযোগীকেও তিনি দলে ভিড়িয়েছেন। এ অবস্থায় ওই একই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের অপর এক নেতা বিকল্প সন্ত্রাসী দল গোছানোর চেষ্টা করছেন। যা এখন এলাকায় অনেকটাই 'ওপেন সিক্রেট'। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলের পাশাপাশি স্থানীয় এলাকাবাসীও উৎকণ্ঠিত বলে ওই সূত্রটি দাবি করেছে।
রাজনীতিতে নতুন করে অপরাধ জগতের ডনদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে বিএনপির প্রথম সারির একজন নেতা জানান, তার আসনেই এ নিয়ে যেভাবে দর কষাকষি শুরম্ন হয়েছে তাতে তিনি নিজেই আতঙ্ক বোধ করছেন। এ পরিস্থিতি থাকলে আগামী নির্বাচনে তিনি অংশ নেবেন না দাবি করে ওই নেতা বলেন, 'কোটি কোটি টাকা সন্ত্রাসীদের পেছনে ঢেলে ভোটবাক্স ছিনিয়ে নিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার কোনো মানে হয় না।'
২০০৮ সালের নির্বাচনে ঢাকার একটি আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পাওয়া একজন প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, সহায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়াও বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও দলের অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী তাতে অংশ নেয়া থেকে দূরে থাকবেন। এ ব্যাপারে তিনি তার যুক্তি তুলে ধরে বলেন, এমনিতেই পুলিশর্ যাবসহ গোটা প্রশাসন ক্ষমতাসীনদের হাতে। এর উপর সন্ত্রাসীরাও দলে দলে সে দিকেই যোগ দিচ্ছে। এ অবস্থায় নিরম্নত্তাপে নির্বাচন করার চেষ্টা করলেও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মুখে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
বিএনপি ওই নেতার দাবি, সন্ত্রাসীদের দলে ভেড়ানোর জন্য ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা যেভাবে ওঠেপড়ে লেগেছে, তাতে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে পালস্না দেওয়াই দূরহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের শেল্টারে থাকলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে বড় 'ছাড়' পাওয়া যাবে- এমন হিসেবনিকেষে সন্ত্রাসীরা সেদিকেই বেশি ঝুঁকছে বলে মনে করেন তিনি।
তার এ ধারণা যে অমূলক নয় তা স্বীকার করে সহকারী কমিশনার (এসি) পদমর্যদার একজন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সহযোগী হিসেবে এখন এমন অনেকেই নাম লিখিয়েছে, যাদের একটি বড় অংশই পুলিশের তালিকাভুক্ত আসামী। অথচ এ অবস্থায় তাদের কারো বিরম্নদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এমনকি এসব ক্যাডাররা বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে অস্ত্রের শো-ডাউন করছেন। এ অবস্থায় 'বাধ্যগত' পুলিশের নিঃস্ক্রিয় ভূমিকা গোটা বাহিনীকে জনগণের কাছে আস্থাহীন করে তুলছে।
এ প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের সমর্থনে ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের মিছিলে পুলিশের উপস্থিতিতে সরকারি সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দফায় দফায় হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ পুরোপুরি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। যার ভিডিও ফুটেজ ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনার পরপরই 'ভাইরাল' হয়। পাশাপাশি একাধিক জাতীয় দৈনিকে স্থিরচিত্র 'লিড' ছবি হিসেবে প্রকাশ করে। যা নিরপেক্ষ-নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মকর্তাদের ভীষণভাবে বিব্রত করেছে বলে মনে করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দলপন্থি শিক্ষকদের আহবায়ক ড. মো: আখতার হোসেন খান এ বিষয়ে যায়যায়দিনকে বলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর কাছ থেকে সাধারণ জনগণ নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতা প্রত্যাশা করে। কিন্তু একের পর এক বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় যথাযথো দায়িত্ব পালন না করলে পুলিশের উপর সাধারণ মানুষ আস্থা হারাতে পারে। যা পুরো দেশের জন্যই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের সাবেক ডিন ড. মোর্শেদ হাসান খান এ বিষয়ে যায়যায়দিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপরে বাংলাদেশের জনগণের আস্থা রয়েছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ বা ছাত্র ধর্মঘটসহ বেশ কিছু ঘটনার সময়ে পুলিশের ভূমিকা কিছুটা হতাশাজনক। এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটতে থাকলে পুলিশের উপর সাধারণ জনগণের আস্থায় চির ধরতে পারে। তবে এর জন্য সামগ্রিকভাবে পুলিশকে না যতটা দোষারোপ করা যায়, তার চেয়ে বেশি দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের। কারণ স্থানীয় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত্মের দিকে তাকিয়েই পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে হয়। এসব ঘটনার জন্য পুলিশের ভূমিকার পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকাকে সঠিকভাবে নির্ধারণ করা গেলেই সমস্যার মূল বের করা যাবে।'
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন