স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই সমানে হাত চালান তিনি। তা হোক ইউএনও, ওসি কিংবা শিক্ষক। অবৈধ কাজে বাধা হওয়ায় নিজ দলের সাবেক নেতাকে পেটানোর অভিযোগও আছে। সরকারি তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে জমি দখল, ঘুষ গ্রহণের মতো অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। তারপরও বহাল তবিয়তে এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
ক্ষমতাধর এই ব্যক্তি হচ্ছেন বরগুনার তালতলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান ওরফে মিন্টু। তিনি উপজেলা যুবলীগের সভাপতিও।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনিরুজ্জামান চেয়ারম্যান হওয়ার পর সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজনকে লাঞ্ছিত ও মারধর করেন। পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছেন। জমি দখল, ঘুষ-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সন্ত্রাসী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
মারধরের শিকার ব্যক্তিরা গত বছরের শুরুতে মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। এরপর মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ওই সময়ের বিভাগীয় কমিশনার মো. শাহেদুজ্জামান তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পান। গত ১ আগস্ট তিনি ১২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠান। মনিরুজ্জামানকে কেন বরখাস্ত করা হবে না-জানতে চেয়ে সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন স্থানীয় সরকার সচিব আবদুল মালেক। গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর ওই নোটিশ পাঠানোর পর পাঁচ মাসের বেশি সময় পার হলেও পরবর্তী প্রক্রিয়া আর এগোয়নি।
সর্বশেষ গত ২৫ ডিসেম্বর তালতলী উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জমি দখলে বাধা দেওয়ায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সাবেক অফিস সহকারী মাহমুদুল হাসানকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে চেয়ারম্যান ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় মাহমুদুল পরদিন তালতলী থানায় গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২ ফেব্রুয়ারি মাহমুদুলের এজাহারটি পুলিশ মামলা হিসেবে গ্রহণ করে। চাঁদাবাজি ও মারধরের ওই মামলায় চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান প্রধান আসামি। এ ছাড়া ১০ আসামির মধ্যে তাঁর ছোট ভাই তারেকুজ্জামান, মেজ ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুজ্জামান রয়েছেন। মামলার দুই আসামি গ্রেপ্তার হলেও দাপটের সঙ্গে এলাকায় আছেন এই চেয়ারম্যান, তাঁর ভাইসহ অন্যরা।
মাহমুদুল উপজেলা ছাত্রলীগের দুবার সাধারণ সম্পাদক ও একবার সভাপতি ছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন, মনিরুজ্জামান স্বাস্থ্য বিভাগের তিন একর আয়তনের একটি পুকুর দখল করেন। এরপর আরও জমি দখল করে অর্থের বিনিময়ে এক ব্যক্তিকে ঘর তুলে দেন। এতে বাধা দিলে মনিরুজ্জামান ক্ষিপ্ত হয়ে গত বছরের মে মাসে তাঁকে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে বদলি করেন। এরপর গত ২৫ ডিসেম্বর তাঁকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে তিনি এখন শয্যাশায়ী। মাহমুদুল বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে দলের জন্য কাজ করে সেই দলের এক সুবিধাভোগী নেতার দ্বারা আমি আজ পঙ্গু হতে বসেছি। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী আছে।’ তিনি বলেন, চেয়ারম্যান ও তাঁর দুই ভাই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না। বরং মামলা তুলে নিতে নানাভাবে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
তালতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পুলক চন্দ্র রায় বলেন, মামলাটি তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে যেই দোষী হবে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
যত অভিযোগ
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো তৎকালীন ইউএনও তোফায়েল হোসেন, ভূমি অফিসের সহকারী জসিম উদ্দিন, তালতলী মাদ্রাসার দপ্তরি শাহজাহান মিয়া, রাখাইন নেতা উসিত মং, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সুন্দর আলী গাজী, শিক্ষক শাহজাহান চৌধুরী, তালতলী থানার সাবেক ওসি কমলেশ হালদার, এসআই আবদুল খালেক, সাংবাদিক নুরুজ্জামান ফারুককে লাঞ্ছিত ও মারধর করেছেন। কুপিয়ে জখম করেছেন অন্য দুজনকে। পাউবোর তিন একর জমি দখল করে স মিল নির্মাণ, রাখাইনদের জমি দখল, গভীর নলকূপ বরাদ্দের জন্য ২০০ জনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়া, উপজেলা চেয়ারম্যানের ছোট ভাই ইয়াবাসহ ধরা পড়ে কারাদণ্ড ভোগসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
তবে উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সবই মিথ্যা ও বানোয়াট। ভূমি সহকারী জসিম উদ্দিনকে জিজ্ঞেস করুন তাঁকে আমি মেরেছি কি না। হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য বিরোধীরা এসব অভিযোগ করছে।’ কারণ দর্শানোর নোটিশের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি সেসবের জবাব দিয়ে দিয়েছি।’
তদন্ত প্রতিবেদন
বিভাগীয় কমিশনার তাঁর তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে একটি ছাড়া সব কটির সত্যতা পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা উপজেলা চেয়ারম্যানের ভয়ে এলাকায় বসে সাক্ষ্য দিতে রাজি হননি। পরে তাঁরা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়ে সাক্ষ্য দেন। এতে তাঁরা বলেছেন, মনিরুজ্জামান খুবই ক্ষমতাধর ব্যক্তি। প্রশাসন ও পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউই তাঁর হাত থেকে রেহাই পান না। এ জন্য সাধারণ মানুষ তাঁর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন। সাক্ষীরা বলেছেন, তাঁরা নিরাপত্তাহীন। তাঁরা অনুরোধ করেছেন তাঁদের নাম যাতে গোপন থাকে। তাঁরা আরও বলেছেন, মনিরুজ্জামান চেয়ারম্যান হয়ে ঘুষ-দুর্নীতি, জমি দখল করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। রাখাইনদের জমি দখল করে সেখানে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে প্রাসাদোপম বাড়ি নির্মাণ করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
কারণ দর্শানোর চিঠি
সচিবের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মাঠপর্যায়ের তদন্তে উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর প্রাথমিক সত্যতা পান। তাই উপজেলা পরিষদ আইন ২০১১ (সংশোধিত) অনুযায়ী এসব অপরাধের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা কেন নেওয়া হবে না, তা নোটিশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে জানাতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবদুল মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নোটিশের জবাব পেয়েছি। সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে চেয়ারম্যান তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এ জন্য বিষয়টি উভয় পক্ষকে নিয়ে পুনরায় শুনানির জন্য রাখা হয়েছে।’
উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামানের কর্মকাণ্ড নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনেও ক্ষোভ ও অস্বস্তি রয়েছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজবি উল কবির বলেন, দলের নাম ভাঙিয়ে যাঁরা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের অপকর্মের দায় দল নেবে না। চেয়ারম্যান ও তাঁর লোকজনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে এলাকায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দলীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ আতঙ্কে আছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন