আওয়ামী লীগের উপকমিটিতে সহ সম্পাদক হিসেবে কথিত তালিকা নিয়ে বিক্ষোভকারীদের ডেকে কথা বলেছেন ওবায়দুল কাদের। এটা আনুষ্ঠানিক তালিকা নয় জানিয়ে দেয়ার পরও বিক্ষোভ করে ‘লোক হাসানোয়’ সাবেক ছাত্রনেতাদের প্রতি বিরক্তিও প্রকাশ করেছেন তিনি।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে কথিত এই তালিকা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই বিক্ষুব্ধ সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা। তাদের অভিযোগ, এই তালিকায় তারা স্থান না পেলেও ছাত্রদল থেকে আসা অনেকের নাম আছে। এমনকি আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় নাম আসারাও স্থান পেয়েছে সহসম্পাদক হিসেবে। তালিকায় মন্ত্রীর কর্মচারীর নামও রয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
শনিবার রাতে ধানমন্ডি ৩/এ তে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে একবার সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের তোপের মুখে পড়েন কাদের। তিনি ভেতরে বৈঠকে থাকা অবস্থায় হৈ চৈ শুনে বের হয়ে এসে বলেন, দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সই ছাড়া যে তালিকা গেছে, সেটি চূড়ান্ত নয়, এটা বাতিল।
পরদিন রবিবার সচিবালয়ে কাদের দাবি করেন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা বিক্ষোভ করেনি, তালিকা বাতিল হয়েছে শুনে আনন্দ মিছিল করেছে। আর ওই ঘটনার বর্ণনা যেভাবে গণমাধ্যমে এসেছে তাতে তিনি কষ্ট পেয়েছেন।
কিন্তু রবিবার বিকাল থেকে ধানমন্ডি ৩/এ কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে থাকেন সাবেক ছাত্রলীগ কর্মীরা। রাত পৌনে আটটার দিকে ওবায়দুল কাদের কার্যালয়ে যাওয়ার পর তাকে আবার ঘিরে ধরেন বিক্ষুব্ধরা। সেখানে কাদের মিনিট পাঁচেক কথা বলেন তাদের সঙ্গে। বলেন, ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের মধ্যে যোগ্য সবাই স্থান পাবে উপকমিটিতে।
এতেও ছাত্রনেতাদের হৈ চৈ থামেনি। পরে কার্যালয়ের ভেতরে তাদেরকে ডেকে নেন ওবায়দুল কাদের। রাত আটটার দিকে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বৈঠকে কাদের ছাড়াও কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামূল হক শামীম, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আবদুস সবুর।
এনামুল হক শামীম সাবেক ছাত্রনেতাদেরকে বলেন, ‘তোমরা কী করছ? আমরা বিষয়টা দেখছি।’
এ সময় সাবেক পাঁচ জন ছাত্রলীগ নেতা কথা বলেন। এরা হলেন: সাবেক সহসভাপতি হাসানুজ্জামান লিটন, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান তারেক, সাবেক দুই ক্রীড়া সম্পাদক আবু আব্বাস ও শাহজাজান শিশির এবং সাবেক পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক মাহফুজার রহমান।
গত দুই দিন ধরে আসা অভিযোগই তারা তুলে ধরেন এ সময়। তাঁরা অভিযোগ করেন, বড় নেতাদের বাসায় কাজ করেও কেউ কেউ উপকমিটিতে পদ পেয়েছেন। কেউ কেউ পদ পেয়েছেন মোটরসাইকেল নিয়ে বড় নেতাদের প্রটোকল দিয়ে। ছাত্রলীগের নতুন নেতারাও পদ পেয়েছেন। এমনকি বিএনপি-জামায়াত ও ছাত্রদলের লোকজনকে পদ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের এ বক্তব্যকে সমর্থন করে সেখানে থাকা বিক্ষুব্ধ নেতারা হইহুল্লোড় শুরু করেন।
এ সময় ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আজ আমি সচিবালয়েও সাংবাদিকদের বলেছি, যে কমিটি গঠনই হয়নি, সেটা কীভাবে বাতিল বা স্থগিত হবে? ওই উপকমিটির জন্য নামের তালিকার একটি খসড়া আছে। সেটা যাচাই-বাছাই করা হবে।’
কাদের আরও বলেন, ‘গতকালই (শনিবার) আমি বলেছি, এই কমিটির কোনো ভিত্তি নাই, এটা বাতিল। তারপরও কেন আজকে ডেমোনস্ট্রেশন করছ? লোক হাসাচ্ছ?’।
আগের রাতের বক্তব্য উল্লেখ করে কাদের বলেন, ‘আমি তিন মাস সময় চেয়েছি, আমার কাছে খসড়া আছে, আমি যাচাই-বাছাই করে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে কমিটি ঘোষণা করব।’
এ সময় একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘ওই খসড়াতে তো আমাদের নাম নাই।’
জবাবে কাদের বলেন, ‘মূল খসড়া থেকে যাচাই-বাছাই করা হবে। তখন কেউ যুক্ত হতে পারে, আবার কেউ বাদও পড়তে পারে।
তবে যারা আওয়ামী লীগের জেলা কমিটি বা অন্য কোনো কমিটিতে আছে, তাদেরকে এই উপকমিটিতে রাখা হবে না বলেও জানিয়ে দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।
সবশেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি বলছি, এখন থেকে কোনো বিক্ষোভ নয়। তিন মাসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে কমিটি দেয়া হবে।’
মিনিট বিশেষ বৈঠকের পর পর সাবেক ছাত্র নেতারা ধানমন্ডি কার্যালয় থেকে বের হয়ে আসেন।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো তালিকায় যাদের নাম নিয়ে বিতর্ক
তালিকায় দেখা যায়, আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সঙ্গে সহ-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এইচ এম মিজানুর রহমান জনিকে। তার বাবা আব্দুল হক বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জ মিশনবাড়ীয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি।
দপ্তর উপকমিটির সহ-সম্পাদক এ কে এম কবির হোসেনের বিরুদ্ধে ছাত্রদলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তিনি।
এ উপকমিটির অপর সহ-সম্পাদক ফয়সল আহমেদ রিয়াদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এছাড়া সংস্কৃতিবিষয়ক উপকমিটির সদস্য হিসেবে আছেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী এস ডি রুবেল। তিনি বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন দীর্ঘদিন। তিনি ছাত্রদলের ঢাকা কলেজ শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদকও ছিলেন।
শ্রম ও জনশক্তিবিষয়ক উপকমিটির সহ-সম্পাদক হিসেবে নাম আসে কামিল হোসেন ঢালীর। তার বিরুদ্ধে পুরান ঢাকায় চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবাহান গোলাপের ঘনিষ্ঠ।
ওই তালিকা অনুযায়ী রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে সহ-সম্পাদক হয়েছেন এস এম এনামুল হক আবীর।
রাসেল নামের একজন সহ-সম্পাদক হয়েছেন, যিনি আওয়ামী লীগের এক উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও মন্ত্রীর বাসার কাজের লোক। অর্থ ও পরিকল্পনা উপকমিটির সহ-সম্পাদক এস এম সাইফুল্লাহ আল মামুন, এ উপকমিটির চেয়ারম্যান মশিউর রহমানের খুব ঘনিষ্ঠ। এর জোরেই তিনি এ পদে আসীন হয়েছেন।
এ কমিটির অপর সহ-সম্পাদক জিয়াউল আবেদীনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে ছাত্রদল-সংশ্লিষ্টতার। অভিযোগ রয়েছে কৃষি ও সমবায় উপকমিটির এক সহ-সম্পাদক হয়েছেন অর্থের বিনিময়ে।
সহ-সম্পাদক আলতাফ হোসেন বিপ্লব ও অসীম সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে জমি দখলের।
শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সহ-সম্পাদক আবিদুর রহমান লিটু রাজনীতিতে অপরিচিত।
একই উপকমিটির আরেক সহ-সম্পাদক ফারুক আহম্মদের (জাপানী ফারুক) বিরুদ্ধেও রয়েছে ছাত্রদল সম্পৃক্ততার অভিযোগ।
ওই তালিকা অনুযায়ী জহির নামের একজন ইতালি প্রবাসীও সহ-সম্পাদক হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে তিনি ছয় মাস দেশে আর ছয় মাস ইতালি থাকেন।
উপকমিটির শফিকুল বাবু ও রেজাউল করিম সুইটের বিরুদ্ধেও ছাত্রদল সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া ছাত্র ও রাজবাড়ী জেলা ছাত্রদলের এক নেতাও উপকমিটিতে জায়গা পেয়েছেন।
জেলা কমিটির সদস্য হওয়ার পরও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটিতে জায়গা পেয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জয়দেব নন্দী (যশোর), ফাহিম হোসেন (মানিকগঞ্জ), ইসহাক আলী খান পান্না (পিরোজপুর)।
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন