একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আগেভাগেই সব প্রস্তুতি সেরে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। হ্যাটট্রিক জয়ের লক্ষ্যে গেল বছর থেকেই একাদশ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি শুরু করে দলটি। আর চলতি বছরের শুরুতে তাতে আরো গতি সঞ্চারের চেষ্টা করছে তারা। ইতোমধ্যে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকটি বিভাগ ও জেলা সফরের সিডিউল মোটামোটি চূড়ান্ত করেছেন। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যসহ কেন্দ্রীয় সদস্যদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে ১৫টি সাংগঠনিক টিম। এ ছাড়া দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের আগে থেকেই বিভিন্ন স্তরের জরিপ করছে দলটি। জরিপ, মাঠ পর্যালোচনা ও অতীত কর্মকাণ্ড বিবেচনা করে নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারে- এমন প্রার্থীদের আগামী মার্চের মধ্যেই কেন্দ্র থেকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেয়া হবে বলেও নিশ্চিত করেছে দলের একটি সূত্র। আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, আগামী নির্বাচনে জয়ের বিকল্প নেই তাদের। তাই নির্বাচনের আগেই সব দিক দিয়ে এগিয়ে থাকতে চাইছেন তারা। দলীয় প্রার্থী বাছাই থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন, উন্নয়ন প্রচার, বিএনপি-জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড জনগণের সামনে তুলে ধরতে উঠান বৈঠক, বর্ধিতসভা, কর্মিসভা, পথসভা, জনসভাসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন তারা।
জাতীয় নির্বাচন এবং তার আগে কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় নামছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুণ্যভূমি সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে এই সফর শুরু হবে। আর ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে সিলেটসহ রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনা সিটিতে নির্বাচনী জনসভা করবেন তিনি। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে রংপুর, কক্সবাজারসহ বড় বড় শহরগুলোতে জনসভায় যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। দলের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা নেতাদের এমন মনোভাবের কথা জানিয়েছেন। এ জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে প্রস্তুতিও নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এর আগে গত বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর যশোরে জনসভা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত ওই জনসভায় শেখ হাসিনা আবারো নৌকাকে বিজয়ী করতে দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম মানবকণ্ঠকে বলেন, আমরা অনেক আগে থেকেই আমাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছি। আমাদের নেতাকর্মীরাও মাঠে নেমেছেন। এ মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হলেন শেখ হাসিনা, আর সবচেয়ে জনপ্রিয় দল আওয়ামী লীগ। বাংলার মানুষ বিশ্বাস করে শেখ হাসিনার ভাগ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য জড়িত। বাংলাদেশকে ভালো রাখতে হবে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে। আমরা শেখ হাসিনা সরকারের আমলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে জনগণকে বোঝাচ্ছি। পাশাপাশি সাংগঠনিক প্রস্তুতিও চলছে। আওয়ামী লীগ এক্যবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে এবং আশা করি বিজয়ী হবে। বিএনপি-জামায়াতকে উদ্দেশ্য তিনি বলেন, যারা আন্দোলনে পরাজিত হয়, তারা নির্বাচনেও পরাজিত হবে।
এদিকে কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সমন্বয়ে ১৫টি টিম গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। আগামী ২৬ জানুয়ারি থেকে ৭৪টি সাংগঠনিক জেলায় আনুষ্ঠানিক সফর শুরু করবে এই টিমগুলো। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে এক নম্বর টিম দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী সফর করবেন। দুই নম্বর টিমের প্রধান উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু। তারা রংপুর, রংপুর মহানগর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলা সফর করছেন। এ ছাড়া সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে তিন নম্বর টিম- চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, রাজশাহী মহানগর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা; লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খানের নেতৃত্বে চার নম্বর টিম জয়পুরহাট, বগুড়া, নওগাঁ ও নাটোর; পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে পাঁচ নম্বর টিম বাগেরহাট, খুলনা, খুলনা মহানগর, সাতক্ষীরা, যশোর ও নড়াইল সফর করবেন।
কাজী জাফর উল্লাহর নেতৃত্বে ৬ নম্বর টিম মাগুরা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর; আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে সাত নম্বর টিম বরিশাল, বরিশাল মহানগর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলা; সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে আট নম্বর টিম গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলা; ড. মো. আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে নয় নম্বর টিম টাঙ্গাইল, শেরপুর ও জামালপুর জেলা; সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে ১০ নম্বর টিম নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ মহানগর ও কিশোরগঞ্জ জেলা সফর করবেন।
আবুল মাল আবদুল মুহিতের নেতৃত্বে ১১ নম্বর টিম সিলেট, সিলেট মহানগর, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলা; ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে ১২ নম্বর টিম রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম মহানগর ও কক্সবাজার জেলা; শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নেতৃত্বে ১৩ নম্বর টিম কুমিল্লা, কুমিল্লা মহানগর, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা; অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরুর নেতৃত্বে ১৪ নম্বর টিম নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী জেলা এবং ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে ১৫ নম্বর টিম রাজধানী ঢাকা, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ মহানগর, গাজীপুর, গাজীপুর মহানগর ও মানিকগঞ্জ জেলা সফর করবেন।
দলীয় সূত্রে ও নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত টিমগুলো সংগঠনিক জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা পর্যায়ে সাংগঠনিক সফরে যাবে এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবে। প্রতি শুক্রবার ও শনিবার সমন্বয় সভা হবে। ওই সভার মাধ্যমে জেলা, উপজেলা ও থানাগুলো সভাসমাবেশের তারিখ নির্ধারণ করবে। এ সব সভায় কেন্দ্রীয় নেতারা নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করার পাশাপাশি বিগত দিনে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন চলাকালে অগ্নি-সন্ত্রাসের ভয়াবহ খণ্ডচিত্র তুলে ধরবেন। এ ছাড়া সরকারের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে জনমত গঠনের চেষ্টা করবেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ মানবকণ্ঠকে বলেন, সংবিধান অনুসারে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর বা ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই হিসেবে ২০১৮ সাল হবে নির্বাচনের বছর। এই বছর জুড়েই আমাদের নির্বাচনী তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। ইতোমধ্যে আমাদের দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে ১৫টি সাংগঠনিক টিম গঠন করা হয়েছে। তারা সারা দেশে সাংগঠনিক সফর শুরু করবেন। এই সফরে তারা জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যন্ত সভা-সমাবেশ, কর্মীসভা করবেন। এসব কর্সসূচিতে একদিকে যেমন সরকারের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরা হবে, তেমনি বিএনপি-জামায়াতের জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের চিত্রও তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে এবার নির্বাচনে আগেভাগেই দলীয় প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করতে চায় আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে দলের পক্ষ থেকে মাঠে বিভিন্ন জরিপ করছে দলটি। দলীয় জরিপের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি সংস্থার জরিপের ফলাফলও বিবেচনায় রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এই জরিপের ফলাফল ও মাঠ পর্যালোচনার ভিত্তিতে তফসিল ঘোষণার অনেক আগেই দলীয় প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করে তাদের জানিয়ে দেবেন দলের হাই কমান্ড। ইতোমধ্যে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলোতে এই পদ্ধতিতে এগুতে শুরু করেছে দলটি। ঢাকা উত্তরে আতিকুল, রাজশাহীতে লিটন, সিলেটে কামরান ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে জাহাঙ্গীরকে ‘গ্রিন সিগনাল’ দিয়ে ভোটের মাঠে আরো সরব হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলটি এই পদ্ধতি অবলম্বন করার কথা ভাবছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দু’ নেতা মানবকণ্ঠকে জানান, তফসিলের অনেক আগেই, এটা মার্চের মধ্যেও হতে পারে; যোগ্য প্রার্থীদের কাছে মেসেজ পৌঁছে যাবে। তাদের আরো বেশি করে জনগণের কাছে যেতে বলা হবে। আপা (শেখ হাসিনা) সবার খোঁজ-খবর রাখেন। তিনি মাঠের সব হিসেব-নিকাশ করেই সিদ্ধান্ত নেবেন।
এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন থেকেই ভোট কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন ও দলীয় এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজও শিগগিরই শুরু করতে চায় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই এ সব প্রস্তুতি সেরেও রাখতে চায় দলটি। গত মঙ্গলবার রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক জেলাগুলোর সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। বৈঠকে ওবায়দুল কাদের নেতাদের নির্বাচন সামনে রেখে ভোট কেন্দ্রভিত্তিক আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। পাশাপাশি দলে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নতুন ভোটারদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে দলকে নির্বাচনমুখী করে তোলারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন