নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে প্রকাশ্য রাস্তায় পিটিয়ে ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে হত্যার চেষ্টা করেছে দুর্বৃত্তরা। কিন্তু ‘ইট-বৃষ্টি’র সময় মেয়র আইভী’র সমর্থকরা মানবদেয়াল তৈরি করে লাঠি ও ইটপাটকেলের আঘাত সহ্য করে মেয়রকে প্রাণে রক্ষা করেছেন। মঙ্গলবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ শহরে এই ঘটনা ঘটে।
মঙ্গলবার বিকেল ৪টা থেকে হকার ও সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সমর্থকদের সঙ্গে মেয়রের সমর্থকদের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের ২ নম্বর রেল গেইট এলাকা থেকে চাষাঢ়া এলাকা পর্যন্ত সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী চলে এই সংঘর্ষ। বন্ধ হয়ে যায় যানবাহন চলাচল। এ ঘটনায় নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এ সময় নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শরীফ উদ্দিন সবুজসহ কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়। সংঘর্ষ ঠেকাতে পুলিশ প্রায় ৩০০ ফাঁকা গুলি ও বেশ কিছু কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোঁড়ে।
এ ঘটনায় পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের প্রত্যাহার চেয়েছেন মেয়র আইভী। বিষয়টি তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করবেন বলেও জানিয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিকেল ৪টার দিকে মেয়র আইভী নগর ভবন থেকে বের হয়ে নগরীর বঙ্গবন্ধু রোডের ফুটপাত দিকে হাটতে শুরু করেন। এ সময় তার সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা কর্মচারী ও বেশ কিছু সমর্থক ছিলেন। পুলিশও তাদের সঙ্গে থাকে। একপর্যায়ে আইভীর সমর্থকরা ফুটপাতে হকারদের বসতে নিষেধ করলে প্রথমে হকাররা ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। তখন হকারদের সঙ্গে আইভীর সমর্থকদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। চাষাঢ়া এলাকায় শামীম ওসমানের সমর্থকরা হকারদের সঙ্গে যোগ দেয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে হকার ও শামীম ওসমান সমর্থকদের হামলার মুখে মেয়র আইভী বঙ্গবন্ধু সড়কে অনড় অবস্থান করেন। এ সময় তারা মেয়র আইভীর ওপর হামলা চালালে সমর্থকরা মানবদেয়াল তৈরি করে তাঁকে ঢেকে রাখে। এ সময় তাদের ছোড়া ঢিলে মেয়র আইভী আহত হন।
পরে হকারদের সমর্থনে সংসদ সদস্য শামীম ওসমান রাজপথে নেমে আসেন। তিনি হকারদের পক্ষ নিয়ে বঙ্গবন্ধু সড়কে অবস্থান করেন। এ সময় আহত আইভী নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবে অবস্থান নেন। পরে আইভীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
পুলিশ প্রায় ৩০০ ফাঁকা গুলি ও বেশ কিছু কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোঁড়ে এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনার পর থেকে এখনো নারায়ণগঞ্জে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
মেয়র আইভী অভিযোগ করেছেন, শামীম ওসমানের নির্দেশে তাঁর বাহিনী হঠাৎ করে শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলা চালিয়ে গুলি ছুড়ে। তিনি দাবি করেন, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল কাদির, সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, আবু সুফিয়ান, মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা উজ্জ্বল, শহিদুল্লাহসহ ৩০ জন আহত হয়।
আইভী আরো বলেছেন, ফুটপাথ জনগণের জন্য মুক্ত রাখতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে। সেই ক্ষেত্রে শামীম ওসমান একজন এমপি হয়ে কীভাবে ফুটপাথে হকারদের বসার নির্দেশ দেন। গতকাল শামীম ওসমান নগরীর চাষাঢ়ায় জনসভা করে হকারদের বসার নির্দেশ দেওয়ার পর থেকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার তাঁর পক্ষ নেন। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার একটি গার্মেন্টস কারখানায় গিয়ে মিটিং করেন।
আইভী অভিযোগ করে আরো বলেন, শামীম ওসমান লাশের রাজনীতি করেন। তিনি মেধাবী ছাত্র ত্বকীকে হত্যা করেছেন। তার ভাতিজা আজমেরী ওসমান নাট্যকার চঞ্চলকে হত্যা করেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বলেন, হকার্স উচ্ছেদ করে মেয়র আইভী অন্যায় করেছেন। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে হকার্সদের বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বসার নির্দেশ দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, এর আগে ডিসেম্বরের শেষ দিকে নগরী থেকে হকার উচ্ছেদ করেছিল সিটি করপোরেশন। আর তাদেরকে বসতে দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন শামীম ওসমান। সোমবার তিনি মেয়রকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে বলেন, হকাররা নারায়ণগঞ্জে বসবে, এটা তার অনুরোধ নয়, এটা তার নির্দেশ। মেয়র আইভীও জবাব দেন এভাবে যে, নারয়ণগঞ্জ শহরশামীমের এলাকা না। এখানে তার নির্দেশ চলবে না।
দুই নেতার অনঢ় অবস্থানের কারণে সকাল থেকেই নগরীতে ছিল উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। চাষাঢ়ায় শহীদ মিনার এলাকায় অবস্থান নেয় পুলিশও। বিকাল ৪ টা ১৮ মিনিটে নগর ভবনের সামনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও কাউন্সিলরদের নিয়ে অবস্থান নেন মেয়র আইভী। ওখান থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম আবু সুফিয়ান আইভীর পক্ষে কয়েক হাজার নেতাকর্মীদের নিয়ে শোডাউন করে চাষাড়ার দিকে আসতে থাকেন। পরে নেতাকর্মীদের নিয়েই আইভী হকার উচ্ছেদ করতে করতে চাষাড়ার দিকে আসতে থাকেন। এসময় আইভীর সঙ্গে সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা, পুলিশ সদস্যরাও ছিলেন।
অপর দিকে হকার এবং শামীম ওসমানের অনুসারীরা অবস্থান নিয়েছিলেন চাষাঢ়া শহীদ মিনারে। আইভী যখন চাষাঢ়া সায়েম প্লাজার সামনে আসেন, তখন শামীম ওসমানের লোকজন আইভীর লোকজনদের বাধা দেয়।
এসময় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এতে মেয়র আইভী, নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শরীফুদ্দীন সবুজ ও শামীম ওসমানপন্থী মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি জুয়েল হোসেনসহ অর্ধশতাধিক নেতা কর্মী আহত হন। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। আর কয়েকশ পুলিশ এসে দুই পক্ষকে দুই দিকে সরিয়ে দেয়।
বিকাল ৫টা ৫ মিনিটে চাষাঢ়া রাইফেলস ক্লাব থেকে বের হন শামীম ওসমান। নেতাকর্মীদের নিয়ে তিনি চাষাঢ়া সায়াম প্লাজা পর্যন্ত শোডাউন করেন। অপরদিকে আইভী তার নেতাকর্মীদের নিয়ে চাষাড়া ত্যাগ করেন। পরে শামীম ওসমান রাইফেলস ক্লাবে ফিরে যান।
এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের সকল মার্কেট বন্ধ হয়ে যায়। যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন