বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানিতে তাঁর আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, এই মামলায় এখন পর্যন্ত যা চলছিল তা স্বাভাবিক নয়। এটা আসলে কোনো মামলাই না। এ রকম মামলা বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক নেতাদের নিঃশেষ করার জন্য করা হয়ে থাকে। এখানেও তা-ই হয়েছে। এতে আমাদের নেত্রীর কোনো ক্ষতি হবে না; বরং তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়বে। তিনিই হবেন বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।’
আজ মঙ্গলবার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় বিশেষ জজ আদালতের ৫-এর বিচারক ড. আখতারুজ্জামান আদালতে এসব কথা বলেন ।
এর আগে খালেদা জিয়া আজ আদালতে উপস্থিত হন বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে। তিনি আসার পাঁচ মিনিট পর কার্যক্রম শুরু করেন বিশেষ জজ আদালত ৫-এর বিচারক আখতারুজ্জামান।
যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আদালতে তিনটি বিষয় উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমত, এই দুটি মামলার নথি জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। বিষয়গুলো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে অনেক আগেই মামলাটি খারিজ হয়ে যেত। যেহেতু মামলাটি রাজনৈতিক, তাই খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতে এটা করা হয়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলার মতো রাজনীতিবিদদের জেল খাটতে হয়েছে। আমাকেও জেলে যেতে হয়েছে। এই মামলায় এখন পর্যন্ত যা চলছিল তা স্বাভাবিক নয়। এটা আসলে কোনো মামলাই না। এ রকম মামলা বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক নেতাদের নিঃশেষ করার জন্য করা হয়ে থাকে। এখানেও তা-ই হয়েছে। এতে আমাদের নেত্রীর কোনো ক্ষতি হবে না; বরং তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়বে। তিনিই হবেন বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।’
‘দ্বিতীয়ত, মামলা দাখিলের আগে সাধারণত কোনো ব্যক্তির অভিযোগ থাকে। কিন্তু এই মামলায় কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।
তৃতীয়ত, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রপতির প্যাডে এই মামলাটি তৈরি করে। অথচ রাষ্ট্রপতির প্যাডের মামলার অনুমোদনের বিষয়টি ১৯৯১ সালেই বাতিল হয়ে গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের বিধিমালা মোতাবেক এই মামলা দায়ের করা হয়নি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের অধীনে মামলাটি করা হয়েছে। তবে এই মামলার প্রক্রিয়া, অনুসন্ধান ও তদন্তকাজে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইন যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। তাই এ মামলা চলারই কথা না।’
এই তিনটি বিষয়ের ওপর বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করে ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, ‘এই মামলায় খালেদা জিয়াকে সম্মানের সহিত খালাস দেবেন বলে আমি আশা করি। কারণ এই মামলার আইনি কোনো ভিত্তি নেই।’
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে আজ মঙ্গলবার শুনানিতে অংশ নেন তাঁর আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। পরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম
মামলার কার্যক্রমকে ক্যামেরা ট্রায়ালের সঙ্গে তুলনা করে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘এখানে আইনজীবীদের জন্য কোনো বসার ব্যবস্থা নেই, এখানে নির্যাতনমূলক বিচার হচ্ছে বলে আমি মনে করি। কারণ এখানে অনেক আইনজীবী আসতে পারেন না, সাধারণ মানুষও আসতে পারে না। এরপরও এখানে খালেদা জিয়ার আরো ১৪টি মামলা স্থানান্তর করা হয়েছে। আমরা হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগে যখন মামলা পরিচালনা করি তখন বিচারক এবং আইনজীবীদের দূরত্ব থাকে আট ফিট। কিন্তু এখানে দূরত্ব ১০০ ফিটেরও বেশি। আপনাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এতটা দূরত্ব রাখা হয়েছে যা কোনোভাবেই ঠিক নয়। মামলার শুনানিরও ভালো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।’
সর্বশেষে আদালতকে উদ্দেশ করে খালেদা জিয়ার এই আইনজীবী বলেন, ‘এতদ্বারা আপনি এই মর্মে উপসংহারে আসবেন যে সম্মানের সহিত খালেদা জিয়াকে খালাস দেবেন।’
এরপর অ্যাডভোকেট সানাউল্ল্যাহ মিঞা আদালতে আগামী তিনটি কার্যদিবসে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত হাজিরা ও স্থায়ী জামিনের আবেদন করেন। তিনি আদালতকে বলেন, ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক অসুবিধার কারণে খালেদা জিয়া আগামী দুদিন তাঁর ব্যক্তিগত উপস্থিতি থেকে অব্যাহতি চান। তিনি খালেদা জিয়ার স্থায়ী জামিনও প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, এর আগে আদালত খালেদা জিয়ার অস্থায়ী জামিন মঞ্জুর করেছিলেন। সে স্থলে স্থায়ী জামিনের আদেশ দেওয়া হোক।
ওই সময় এর বিরোধিতা করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। এর আগে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না মর্মে হাইকোর্ট থেকে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা একটি আদেশ আনেন। সেই আদেশ উল্লেখ করে মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এই মামলার সমস্ত কার্যক্রম খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে পরিচালনার জন্য হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের আপত্তি আছে।
উভয়ের শুনানির পর খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি এবং স্থায়ী জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে দেন আদালত।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়। কিন্তু জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত এক কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেওয়া হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়, যার কোনো বৈধ উৎস ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি। জমির মালিককে দেওয়া ওই অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে মোট তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
২০১০ সালের ৮ আগস্ট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের নামে তেজগাঁও থানায় দুর্নীতির অভিযোগে এ মামলা করেছিলেন দুদকের সহকারী পরিচালক হারুন-অর-রশিদ।
এ মামলার অপর আসামিরা হলেন—খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন