গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের জেলা-উপজেলা ও কলেজ কমিটির মেয়াদ এক বছরের পর অবৈধ। এ হিসেবে সাত মাস আগে অবৈধ হয়ে গেছে জেলা কমিটি।
তার পরও এই কমিটি চার উপজেলা, শহর এবং একটি কলেজে কমিটি ছাড়াই চালাচ্ছে কার্যক্রম। এ কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা বলেন, ‘জেলা ছাত্র লীগ চলছে এখন হাওয়ার ওপর। ’
সাবেক নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে জানায়, ছাত্রলীগের এই অবৈধ কমিটির নেতারা শহরের রাজাবাজারে এক ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি, পৌরসভার দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, টাকা নিয়ে জায়গা দখল করে দিয়েছেন।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানায়, কমিটির ১ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুর ইসলাম তাইজুল অছাত্র। তিনি বগুড়া সদর উপজেলার নুনগোলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার)। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার রায়ের আস্থাভাজন হিসেবে তাঁর পরিচিতি। ৮ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীম পোদ্দার জামায়াত পরিবারের সদস্য। ১৫ নম্বর সদস্য আসিফ হাসান সিজান নৌ প্রকৌশলী। তিনি নানা দেশে ঘুরে বেড়ান।
ক্রীড়া সম্পাদক মেহেদী হাসান হত্যা মামলার আসামি। সহসভাপতি মেহেদী হাসান (দ্বিতীয়) বিবাহিত। বগুড়া হকার্স মার্কেটে তাঁর দোকান রয়েছে। সহসম্পাদক ওসমান গনি শুভ বগুড়া পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে প্রকাশ্যে দরপত্র বাক্স ছিনতাই মামলার আসামি। এই অভিযোগে দুই মাসের বেশি হাজতবাস করতে হয়েছে তাঁকে। সাংগঠনিক সম্পাদক তাজমিলুর রহমান তমাল বালু ব্যবসায়ী। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে। একটি মোবাইল ফোনসেট ছিনতাই মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত কুমার দাস আগে যুবলীগ করতেন। অতীতে ছাত্রলীগের কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ না নিলেও দপ্তর সম্পাদক হয়েছেন ফয়সাল আহম্মেদ। মামলার আসামি উপ-ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন মনিরুজ্জামান সাব্বির। এ ছাড়া সদস্য মোজাম্মেল হোসেন ও গোলাম রাব্বি অন্য জেলার বাসিন্দা।
মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতে চলছে সান্তাহার সরকারি কলেজ, গাবতলী সরকারি কলেজ এবং সোনাতলা নাজির আখতার সরকারি কলেজের দলীয় কার্যক্রম। ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের তিনটি কলেজ কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেই হিসেবে ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এসব কমিটির কার্যক্রম অবৈধ হয়েছে।
বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ২০টি সাংগঠনিক ইউনিটের মধ্যে ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহর ছাত্রলীগ, সদর উপজেলা ছাত্রলীগ, সান্তাহার সরকারি কলেজ, গাবতলী সরকারি কলেজ, সোনাতলা সরকারি নাজির আখতার কলেজ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এক বছরের স্থলে কমিটির মেয়াদ পৌনে তিন বছর হলেও এসব সাংগঠনিক ইউনিটের সম্মেলন হয়নি। উল্টো মাস দুয়েক আগে বগুড়া শহর কমিটির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
২০১৬ সালের ৪ নভেম্বর কে এম মোজাম্মেল হোসেনকে সভাপতি এবং আবদুর রউফকে সাধারণ সম্পাদক করে সরকারি আজিজুল হক কলেজ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এক বছরেও এর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়নি।
মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে সরকারি শাহ সুলতান কলেজ ছাত্রলীগের কমিটিও। উপরন্তু ১২ সেপ্টেম্বর অধ্যক্ষের কার্যালয়ে হামলার জেরে শাহ সুলতান কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি বিশ্বজিৎ কুমারসহ তিন নেতকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর পর থেকে সেখানে স্থবির ছাত্রলীগের কার্যক্রম। ভর্তি বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ায় ২০১৬ সালের ৩০ জুন সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়।
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগে সম্প্রতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোনাতলা বাদে অন্য ১১টি ইউনিটের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতে চলছে শিবগঞ্জ ও দুপচাঁচিয়া উপজেলা ছাত্রলীগ। সারিয়াকান্দি উপজেলা ছাত্রলীগ চলছে আহ্বায়ক কমিটিতে।
২০১২ সালের পর থেকে সম্মেলন না হওয়া অন্য আট উপজেলা কমিটি বিলুপ্ত করে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের জন্য জেলা ছাত্রলীগকে গত ৬ জুলাই নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৩ জুলাই শাজাহানপুর, ২৪ জুলাই শেরপুর, ২৫ জুলাই ধুনট, ২৬ জুলাই আদমদীঘি, ২৩ সেপ্টেম্বর সারিয়াকান্দি, ২৪ সেপ্টেম্বর কাহালু, ২৫ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও ২৬ সেপ্টেম্বর নন্দীগ্রাম উপজেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন হওয়ার কথা। কেন্দ্রের নির্দেশ অনুযায়ী শেরপুর, ধুনট ও শাজাহানপুরে সম্মেলন হয়েছে। তবে এই তিন উপজেলায় এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। সারিয়াকান্দি উপজেলায় সম্মেলনের বদলে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুনর্ঘোষিত তারিখ অনুযায়ী ৬ নভেম্বর আদমদীঘি, ৭ নভেম্বর কাহালু, ৮ নভেম্বর গাবতলী এবং ৯ নভেম্বর নন্দীগ্রাম উপজেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এর মধ্যে আদমদীঘি এবং কাহালুতে নির্ধারিত দিনে সম্মেলন হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কমিটি ঘোষণা হয়নি। অন্যদিকে সম্মেলন করতে ব্যর্থ হওয়ায় গাবতলী ও নন্দীগ্রাম উপজেলা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহর ছাত্রলীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়। কমিটির মেয়াদ পৌনে তিন বছর হলেও সম্মেলন হয়নি। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সম্প্রতি এই কমিটির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে। তবে কেন্দ্র থেকে পাঠানো এসংক্রান্ত চিঠিতে কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। শুধু লেখা হয় ‘অনিবার্য কারণে’ কমিটি বিলুপ্ত করা হলো।
বগুড়া শহর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অরছি হাজারি সম্প্রতি ফেসবুকে এক নেতাকে ইঙ্গিত করে লেখেন, ‘জেলা ছাত্রলীগের বেতন-ভাতা কত টাকা? ফ্ল্যাট বাসায় ভাড়া থাকা, দুই কক্ষে এসি লাগানো, প্রাইভেট কার, বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন। অথচ নিজেকে সাধু সাজাচ্ছেন। ’
এ বিষয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার রায় বলেন, ‘অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বগুড়া ছাত্রলীগ সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী ও পরিচ্ছন্ন। ’
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাঈমুর রাজ্জাক তিতাস বলেন, ‘চার উপজেলায় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। নেতাকর্মীদের ছাত্রত্ব আছে কি না, বয়স ২৯ এবং অবিবাহিত কি না, তা দেখা হচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সব সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করা হবে। ’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন