পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দশক পূর্তির পর থেকে পাহাড়ে ঘটে যাওয়া কয়েকটি পরিকল্পিত ঘটনার পর থেকে সাধারণ পাহাড়িদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যারা যুক্ত তাদের আতঙ্ক সর্বত্রই। অনেকেই ফেসবুক, মোবাইল ফোনের মেসেজেই দেয়া হচ্ছে হুমকি ধামকি, তাই প্রাণভয়ে অনেকেই করেছেন পদত্যাগ। আর তৃনমূলের আওয়ামী লীগের এই বিশাল শক্তিকে ভাঙতে এসব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে জনসংহতি সমিতি; এমনই অভিযোগ করছেন সরকার দলীয় নেতারা।
জানা গেছে, এসব পদত্যাগকারিদের বেশির ভাগই বিলাইছড়ি উপজেলার। বিলাইছড়িতে এপর্যন্ত দেড়-শতাধিক ও বাকি উপজেলাগুলোতে পদত্যাগ করেছেন প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী। বিলাইছড়িতে দেড়-শতাধিক নেতাকর্মীর মধ্যে শতাধিক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে নতুন যোগদান করেছে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন করার পর; এমনটাই জানা গেছে। সব মিলিয়ে পদত্যাগের সারি আর বর্তমান পরিস্থিতিতে পাহাড়ের রাজনীতিতে ভাঙন ধরেছে আওয়ামী লীগের। আর পদত্যাগের এই দীর্ঘ সারির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকেই দায় দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের শির্ষ্য নেতারা।
বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ি উপজেলার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতারা জানান, আমাদের স্থানীয় ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মীরা এখন আতঙ্কে দিন গুনছে। বিশেষ করে এখানকার স্থানীয় আঞ্চলিক দলের কর্মী বাহিনী আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করা তাদের নেতাদের কাছে আমাদের নেতাকর্মীর নাম পৌঁছাচ্ছে। আর তাদের লোকজন আমাদেরকে হুমকি দিয়ে আসছে।
নাম প্রকাশ করতে অইচ্ছুক জুরাছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের পদত্যাগকারী একনেতা জানান, পদত্যাগ করার জন্য আমাকে একটি ‘ফেসবুক আইডি’ থেকে হুমকি দিয়েছে। তারা উদ্দেশ্য করে বলেছিল আমি যেন ১৬ ডিসেম্বর আগেই পদত্যাগ করি, না হয় তারা আমার ক্ষতি করবে। আর যে আইডি থেকে আমাকে হুমকি দেয়া হয়েছিল সেই আইডিটি একটি ফেইক আইডি, যে আইডিটির সাথে আমার কখনোই এড ছিল না।
পদত্যাগকারী এই নেতা আরও জানিয়েছেন, যারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে বেশি সক্রিয় তাদেরকেই দেখে দেখে হুমকি দিচ্ছে গ্রুপটি। যার কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যারা সংযুক্ত তারা অনেকেই আজ বাড়িঘর ছাড়া। প্রান ভয়ে আমিও আজ অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি।
বিলাইছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি উসাইমং মামরা বলেন, আমরা বিলাইছড়িতে ছাত্রলীগের কারো পদত্যাগের কথা শুনতে পাইনি, আমাদর কাছে এখন পর্যন্ত ছাত্রলীগের কোন নেতাকর্মী পদত্যাগ পত্রও জমা দেয়নি। তবে আওয়ামী লীগের কিছু কর্মীর পদত্যাগ করার কথা শুনেছি, তারা কেউ আমাদের দলীয় পদে দায়িত্বে ছিল না। সমর্থক ছিলেন আওয়ামী লীগের।
জুরাছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রিকো চাকমার মুঠোফোনে একাধিবার চেষ্ঠা করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরে সাধারণ সম্পাদক ধন বিকাশ চাকমার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, জুরাছড়ির অবস্থা ভালো না, সবাইকে হুমকি ধামকি দেয়া হচ্ছে তাই আমরা অন্যত্র সরে এসেছি।
জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ চাকমা জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের তৃনমূলের নেতাকর্মীদের হুমকি-দমকি দিয়ে আসছে আঞ্চলিক দলের নেতারা। আমাদের তৃনমূলের ছাত্রলীগ নেতারা প্রাণভয়ের আতঙ্কে আছেন অনেকেই। ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর চুক্তির অনুযায়ী আঞ্চলিক দল জেএসএস অস্ত্র জমা দিলেও তারা এখনো পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রনিয়ে চলাফোরা করছে। বর্তমান সময়েও তারা আমাদের নেতাকর্মীদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে। আর এসব সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের মুখে আমাদের নেতাকর্মীদের পালিয়ে থাকতে হচ্ছে।
জেলা ছাত্রলীগের এই নেতা আরও জানান, সন্ত্রাসীদের মধ্যে যারা যারা আমাদের নেতাকর্মীদের ফেসবুক কিংবা অন্যান্য ভাবে হুমকি দিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে আমরা আইনি-ব্যবস্থা নিবো।
বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম শাহিদুল ইসলাম জানান, রাসেল মারমাকে হত্যাচেষ্ঠার পর এখানকার স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালি সবাই আতঙ্কে আছে। বিলাইছড়িতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা কারোই পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করি নাই। আর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত পদত্যাগের নিউজটি ভূয়া বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জুরাছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রবর্তক চাকমা জানান, আমাদের বিলাছড়ির স্থানীয় আওয়ামী লীগই কেবল নয়, এখানকার স্থানীয় সাধারণ জনগণও এখন আতঙ্কে আছে। নেতাকর্মীদের পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার জানা মতে জুরাছড়িতে প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছে এমন তথ্য পয়েছি, তবে আমার কাছে তেমন পদত্যাগ পত্র আসেনি। ’
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি মুছা মাতব্বর জানিয়েছেন, আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোন নেতাকর্মীর পদত্যাগপত্র হাতে আসেনি। আর পত্র হাতে পেলেও তা গ্রহণ করা হবেনা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মুখপাত্র সজিব চাকমা বলেন, আওয়ামী লীগ সঠিকভাবে না জেনে, না বুঝে সব কিছুতেই জনসংহতি সমিতিকে দায় দিচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনাতে তারা চোঁখ ভুজে আমাদেরকেই দোষারোপ করছে।
দুই উপজেলার সাথে নৌ-পথে নেই যোগাযোগ:
গত তিনদিন ধরে (১২ ডিসেম্বর) রাঙামাটির দুই উপজেলা বিলাইছড়ি ও জরাছড়ির সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম লঞ্চ-বোট বন্ধ চলাচল রয়েছে। এতে করে এ দুই উপজেলার সাথে যোগাযোগ বন্ধ আছে জেলা শহর রাঙামাটির,আর এর কারণে বিপাকে পড়েছে স্থানীয় উপজেলাগুলোর সাধারণ জনগণ। এছাড়া বিলাইছড়ি ও জরাছড়ির সাপ্তাহিক বাজারবার মঙ্গলবারেও বসেনি বাজার। বেঁচাকেনা না থাকায় অলস সময় পার করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
বিলাইছড়ির উপজেলার স্থানীয় একলোক জানান, কেউ হরতাল কিংবা অবরোধের কোন ডাক দেয়নি, তবে আমাদের বিলাইছড়ি বাজারে সাপ্তাহিক বাজারবার মঙ্গলবারে বাজার বসলেও ক্রেতা না থাকায় তেমন বাজার মেলেনি।
একই কথা জানা যায় জুরাছড়ির উপজেলার খোঁজ নিয়েও। নাম প্রকাশ করতে অইচ্ছুক জুরাছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, জেএসএস ঘোষনা না দিলেও তাদের পক্ষ থেকে বাজার বয়কট করা হয়েছে। তা না হলে স্থানীয়রা বাজারে আসছে না কেন?
রাঙামাটি জেলা লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মঈন উদ্দিন সেলিম জানান, ১২ তারিখ থেকেই বিলাইছড়ি ও জরাছড়ির সাথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিলাইছড়ি ও জরাছড়ির নৌ-চালকেরা ভয়ে, আতঙ্কে লঞ্চ চালাচ্ছে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মুখপাত্র সজিব চাকমা বলেন, ব্যাক্তিগত ভাবে আমি নিজেই বিষয়টি ফেসবুক থেকে জেনেছি। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এখন পর্যন্ত এ ধরণের কোন কর্মসূচি দেয় নি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন