পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই দশক পূর্তির পর থেকে পাহাড়ে ঘটে যাওয়া একাধিক হত্যাসহ কয়েকটি পরিকল্পিত ঘটনায় প্রাণের ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে পহাড়ের আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। হত্যসহ নানা ভাবে অব্যাহত হুমকির মুখে অনেকেই পদত্যাগ করছেন আওয়ামলীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো থেকে। তৃনমূলে আওয়ামীলীগের এই বিশাল শক্তিকে ভাঙ্গতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস)এসব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে’ এমন অভিযোগ করছেন সরকার দলীয় নেতারা।
.
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, ফেসবুক, মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও মেসেজে দেয়া হচ্ছে হুমকি-ধমকি। তাই প্রাণভয়ে অনেকেই করেছেন পদত্যাগ।
জানা গেছে, এসব পদত্যাগকারিদের বেশির ভাগই রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার। বিলাইছড়িতে এপর্যন্ত দেড় শতাধিক ও বাকি উপজেলাগুলোতে পদত্যাগ করেছেন প্রায় শতাধিক নেতাকমী।
সব মিলিয়ে পদত্যাগের দীর্ঘ সারি আর বর্তমান পরিস্থিতিতে পাহাড়ের রাজনীতিতে ভাঙন ধরেছে আওয়ামীলীগের। আর পদত্যাগের এই দীর্ঘ সারির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকেই দায় দিচ্ছেন আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতারা।
বিলাইছড়ি এবং জুরাছড়ি উপজেলার আওয়ামীলীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতারা জানান, তাদের স্থানীয় ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মীরা এখন আতঙ্কে দিন গুনছে। বিশেষ করে এখানকার স্থানীয় আঞ্চলিক দলের কর্মী বাহিনী, আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করা তাদের নেতাদের কাছে আমাদের নেতাকর্মীর নাম পৌঁছাচ্ছে। আর তাদের লোকজন আমাদেরকে হুমকি দিয়ে আসছে।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক জুরাছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের পদত্যাগকারী এক নেতা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, পদত্যাগ করার জন্য আমাকে একটি ‘ফেসবুক আইডি’ থেকে হুমকি দিয়েছে। তারা উদ্দেশ্য করে বলেছিল আমি যেন ১৬ ডিসেম্বরের আগেই পদত্যাগ করি। না হয় তারা আমার ক্ষতি করবে। আর যে আইডি থেকে আমাকে হুমকি দেয়া হয়েছিলো সেই আইডিটি একটি ফেইক আইডি, যে আইডিটির সাথে আমার কখনোই এড ছিলো না। পদত্যাগকারী এইনেতা আরও জানিয়েছেন, যারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে বেশি সক্রিয় তাদেরকেই দেখে দেখে হুমকি দিচ্ছে গ্রুপটি। যার কারণে স্থানীয় আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে যারা সংযুক্ত তারা অনেকেই আজ বাড়িঘর ছাড়া। প্রান ভয়ে আমিও আজ অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি।
বিলাইছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি উসাইমং মামরা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘আমরা বিলাইছড়িতে ছাত্রলীগের কারো পদত্যাগের কথা শুনতে পাইনি, আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত ছাত্রলীগের কোন নেতাকর্মী পদত্যাগ পত্রও জমা দেয়নি। তবে আওয়ামীলীগের কিছু কর্মীর পদত্যাগ করার কথা শুনেছি। কিন্তু তারা কেউ আমাদের দলীয় পদে দায়িত্বে ছিলো না। সমর্থক ছিলেন আওয়ামীলীগের।’
জুরাছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রিকো চাকমার মুঠোফোনে একাধিবার চেষ্ঠা করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরে সাধারণ সম্পাদক ধন বিকাশ চাকমার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, জুরাছড়ির অবস্থা ভালো না, সবাইকে হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। তাই আমরা অন্যত্র সরে এসেছি।
জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ চাকমা পরিবর্তন ডটকমকে জানিয়েছেন, ‘ছাত্রলীগের তৃনমূলের নেতাকর্মীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছে আঞ্চলিক দলের নেতারা। আমাদের তৃনমূলের ছাত্রলীগ নেতারা অনেকেই প্রাণভয়ের আতঙ্কে আছেন।
জেএসএস অবৈধ স্বশস্ত্র সংগঠন দাবি করে তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর চুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক দল জেএসএস অস্ত্র জমা দিলেও তারা এখনো পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রনিয়ে চলাফেরা করছে। বর্তমান সময়েও তারা আমাদের নেতাকর্মীদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে। আর এসব সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের মুখে আমাদের নেতাকর্মীদের পালিয়ে থাকতে হচ্ছে।
জেলা ছাত্রলীগের এই নেতা আরও বলেন, সন্ত্রাসীদের মধ্যে যারা যারা আমাদের নেতাকর্মীদের ফেসবুক কিংবা অন্যান্য ভাবে হুমকি দিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে আমরা আইনি-ব্যবস্থা নিবো।’
বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম শাহিদুল ইসলাম পরিবর্তন ডটকমকে জানান, রাসেল মারমাকে হত্যাচেষ্ঠার পর এখানকার স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালি সবাই আতঙ্কে আছে। বিলাইছড়িতে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা কারো পদত্যাগ পত্র গ্রহন করি নাই। আর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত পদত্যাগের নিউজটি ভূয়া বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জুরাছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি প্রবর্তক চাকমা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘আমাদের বিলাছড়ির স্থানীয় আওয়ামীলীগই কেবল নয়, এখানকার স্থানীয় সাধারণ জনগণও এখন আতঙ্কে আছে। নেতাকর্মীদের পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার জানা মতে জুরাছড়িতে প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছে এমন তথ্য পয়েছি। তবে আমার কাছে তেমন পদত্যাগ পত্র আসেনি। ’
জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি মুছা মাতব্বর পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, আমাদের হাতে এখন পর্যন্ত কোন নেতাকর্মীর পদত্যাগপত্র আসেনি। আর পত্র হাতে পেলেও তা গ্রহণ করা হবেনা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মুখপাত্র সজিব চাকমা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘আওয়ামীলীগ সঠিক ভাবে না জেনে, না বুঝে সব কিছুতেই জনসংহতি সমিতিকে দায় দিচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনাতে তারা চোঁখ ভুজে আমাদেরকেই দোষারোপ করছে।’
দুই উপজেলার সাথে নৌ-পথে নেই যোগাযোগ
গত তিনদিন ধরে (১২ ডিসেম্বর থেকে) রাঙামাটির দুই উপজেলা বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ির সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম লঞ্চ-বোট চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে করে এ দুই উপজেলার সাথে যোগাযোগ বন্ধ আছে জেলা শহর রাঙামাটির, আর এ কারণে বিপাকে পড়েছে স্থানীয় উপজেলাগুলোর সাধারণ জনগণ। এছাড়া বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ির সাপ্তাহিক হাটেরদিন মঙ্গলবারেও বসেনি বাজার। বেঁচাকেনা না থাকায় অলস সময় পার করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
বিলাইছড়ির উপজেলার স্থানীয় একলোক বলেন, কেউ হরতাল কিংবা অবরোধের কোন ডাক দেয়নি, তবে আমাদের বিলাইছড়ি বাজারে সাপ্তাহিক বাজারবার মঙ্গলবারে বাজার বসলেও ক্রেতা না থাকায় তেমন বাজার মেলেনি।
জুরাছড়ি উপজেলায় খোঁজ নিয়েও একই কথা জানাযায়। নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক জুরাছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগের এক নেতা পরিবর্তন ডটকমকে জানান, ‘জেএসএস ঘোষনা না দিলেও তাদের পক্ষ থেকে বাজার বয়কট করা হয়েছে। তা না হলে স্থানীয়রা বাজারে আসছে না কেন?’
রাঙামাটি জেলা লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মঈন উদ্দিন সেলিম পরিবর্তন ডটকমকে জানান, ১২ তারিখ থেকেই বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ির সাথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ির নৌ-চালকেরা ভয়ে, আতঙ্কে লঞ্চ চালাচ্ছে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মুখপাত্র সজিব চাকমা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘ব্যাক্তিগত ভাবে আমি নিজেই বিষয়টি ফেসবুক থেকে জেনেছি। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এখন পর্যন্ত এ ধরণের কোন কর্মসূচি দেয় নি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন