সদর উপজেলার ২১টি ইউনিয়ন নিয়ে ঠাকুরগাঁও-১ আসনটি জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। হাইপ্রোফাইল রাজনীতিক বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ আসনের প্রার্থী। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রবীণ নেতা ও সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনও এ আসনের এমপি।
আগামী নির্বাচনেও তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশী। আসনটি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের দখলে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মির্জা ফখরুল বিএনপিতে প্রতিদ্বন্দ্বী।
শাসক দল আওয়ামী লীগে বর্তমান এমপি ছাড়াও একাধিক প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। আগামী নির্বাচনে মূল লড়াইটা হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। তবে শাসক দলের মধ্যে যে গৃহবিবাদ চলছে, তা দলকে কিছুটা হলেও দুর্বল করে দিচ্ছে।
২০০১ সালে গৃহবিবাদের কারণেই আওয়ামী লীগ পরাজিত হয় এবং এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জয়ের শিবিরে পৌঁছে যান বিএনপির প্রার্থী। বিবাদ দূর করতে না পারলে আগামী নির্বাচনেও আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। কৃষিনির্ভর এ এলাকায় উল্লেখ করার মতো কোনো শিল্প-কলকারখানা নেই। কৃষিপণ্যই এলাকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস।
ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম ফজলুল করিম ১৯৭৩ সালে এ আসনে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি নির্বাচিত হন। নব্বইয়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা খাদেমুল ইসলাম ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে এমপি হন।
শেষ দফার ভোটে বিজয়ী হওয়ার কিছু দিন পর খাদেমুল ইসলামের মৃত্যু হলে উপনির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে রমেশ চন্দ্র পরাজিত হন।
সরকারি কলেজের অধ্যাপনা চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেয়া ঠাকুরগাঁও পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মির্জা ফখরুল এই প্রথম এমপি নির্বাচিত হন এ আসন থেকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মির্জা ফখরুল আওয়ামী লীগ নেতা রমেশ চন্দ্র সেনের কাছে পরাজিত হন। সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন ২০১৪ সালের নির্বাচনেও বিজয়ী হন।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে মাঠে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেন বাবু, জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইন্দ্রনাথ রায় ও সাবেক যুবলীগ নেতা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অরুনাংশু দত্ত টিটো। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক কুরাইশী ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছেন। তিনিও এ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী।
আওয়ামী লীগের এ নেতা গত উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুলতানুল ফেরদৌস চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন। তবে তিনি তার ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী যদি তাকে মনোনয়ন দেন, তাহলে নির্বাচনের জন্য তিনি প্রস্তুত।
দলীয় কোন্দলের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের পর দলের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়, যা এখনও বিদ্যমান।
আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী স্কুলশিক্ষক নিকুঞ্জ রায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তুষের আগুনে পুড়ছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী এই দল।’ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘দলীয় বিরোধ মিটিয়ে না ফেললে ২০০১ সালের মতো পরাজয় বরণ করতে হবে আগামী নির্বাচনে।’
জগন্নাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গণেশ ঘোষ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিবাদের সুযোগ নিতে চাইবে বিএনপি- এটাই স্বাভাবিক। আগামী নির্বাচনে আসনটি আরেক দফা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।’
এসব অভিযোগ এবং আগামী নির্বাচন নিয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন এমপি বলেন, ‘আমার কাছে দলে কোন্দল মনে হয় না। এটা সাংবাদিকদের তৈরি। ২০০১ সালে দলীয় কোন্দলে নয়, আর্মির কারণে হেরেছি।’
সদর উপজেলা জগন্নাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল খালেক দলীয় কোন্দলের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, টাকার বিনিময়ে জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগের টিকিটে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। স্থানীয় নেতাকর্মীরা এটি ভালোভাবে নেননি।
কথা হয় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জেলার সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী অ্যাডভোকেট ইন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিতে না পারলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
আগামী নির্বাচনে বিএনপি আসনটি নিজেদের দখলে রাখতে চায়। এ লক্ষ্যে অনেক আগে থেকেই কাজ করছে বিএনপি। মির্জা ফখরুলের এ আসনে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে পুরোদমেই।
গ্রাম, পাড়া-মহল্লা ও ইউনিয়ন কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে নানামুখী কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে। বিএনপির পক্ষ থেকে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, দমনপীড়ন, গ্রেফতার, গুম, খুন, হয়রানি, নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির অভিযোগ সুচারুভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারে এসব মূল হাতিয়ার হিসেবে থাকবে। সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এলাকায় একাধিক সভা-সমাবেশে এসব তুলে ধরছেন।
২৪ মে জেলা বিএনপির ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে জেলা সভাপতির পদ ছেড়ে দেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার স্থলে দায়িত্ব নেন সাবেক কমিউনিষ্ট নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা তৈমুর রহমান।
সাধারণ সম্পাদকের হাল ধরেন মির্জা ফখরুলের ছোট ভাই ঠাকুরগাঁও পৌরসভার মেয়র মির্জা ফয়সল আমিন। আগামী নির্বাচন এবং দলের মনোনয়ন নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে দলের একক প্রার্থী হচ্ছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে তার বিজয়ের ব্যাপারে আমরা শতভাগ নিশ্চিত।
এ আসনে বিএনপির সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে মির্জা ফখরুল বিএনপির একক প্রার্থী। এলাকায় জামায়াতেরও একটি শক্ত অবস্থান রয়েছে। ফলে মির্জা ফখরুল ইসলামকে বিজয়ী করতে বিএনপি-জামায়াত কোমর বেঁধে মাঠে নামার অপেক্ষায়।
সম্প্রতি নিজ এলাকা সফরকালে নির্বাচন নিয়ে তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন নিয়ে কথা বলার সময় এখনও আসেনি। কীভাবে, কোন পদ্বতিতে নির্বাচন হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনও রয়ে গেছে। ফলে এ নিয়ে এখনই মন্তব্য করা ঠিক হবে না। এ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন অ্যাডভোকেট ইমরান হোসেন চৌধুরী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন