গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ ধাপ অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। আর এটির অভাবেই বাংলাদেশের বর্তমান গণতন্ত্রের অবস্থা অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে তুলনামূলক নাজুক। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থাটাকে এক প্রকার ধ্বংস করে দিচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের হস্তক্ষেপে প্রশ্নের মুখে পড়ছে গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থা। কথাগুলো বলছিলেন জাহঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম। একই সঙ্গে তিনি মনে করেন সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দেশে আবার গণতন্ত্র ফিরে আসবে। সে প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন তিনি।
শনিবার (২৫ নভেম্বর) এ রাষ্টবিজ্ঞানীর ২০তম বই ‘স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র’র প্রকাশনা উৎসব শেষে ব্রেকিংনিউজ.কম.বিডি’র সঙ্গে একান্ত আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
এ সময় তিনি স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র একেবারই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যে দেশে গণতন্ত্র নেই সে দেশের মানুষের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নেই। স্বাধীনতার জন্য যে দেশেই বিপ্লব হয়েছে তার অধিকাংশই মূলত গণতন্ত্রের জন্যই। তেমনি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিরও জন্ম কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য। স্বাধিকারের জন্য।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পাই, যখন পাকিস্তানী শাসকেরা গণতন্ত্রকে অস্বীকার করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানালো, তখনই বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দেশকে স্বাধীন করে। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও সেই কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র অর্জিত হয়নি। বার বার গণতন্ত্রকে অস্বীকার করার কারণে আজ বাংলাদেশের এ অবস্থা। এক কথায় এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিল তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা কি শুধুই ভূখণ্ডগত স্বাধীনতা?’
এ সময় তিনি পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের দেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র আছে। কিন্তু তার যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার পর থেকে নির্বাচনগুলো যথাযথভাবে হয়নি। আসলে গণতন্ত্র হচ্ছে একটা অনুশীলন। কিন্তু আমাদের দেশে সে অনুশীলনটা ধারাবাহিক ভাবে হচ্ছে না। আমরা লক্ষ্য করলে দেখি বাংলাদেশের সব নির্বাচনই কারো না কারো পক্ষ নিয়ে হচ্ছে। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে এসে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থায় পৌঁছাতে হবে। তাহলেই এ দেশে আবার গণতন্ত্র ফিরে আসবে।’
তত্ত্ববধায়ক সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থাটা আসলো সামাজিক প্রয়োজনে। এটা শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা জামায়াতের দাবির প্রেক্ষিতে এসেছিল, তা কিন্তু নয়। সামাজিক দাবিতে এ ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল। যা গোটা জাতির জন্য একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইনন্সটিউশনে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ইনন্সিটিউশন নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। যা দেশে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য হুমকিস্বরুপ। কারণ দেশের কোনও দলই নিরপেক্ষ নির্বাচন দেয়ার মত উপযোগী নয়। তাই দেশে তত্ত্ববধায়ক সরকারের মত সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে গণতন্ত্র রক্ষা করতে হবে।’
এ সময় তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের দেশে গণতন্ত্রটা এমন হয়েছে যে, নির্বাচনের দিনই শুধু সবার মুখে মুখে গণতন্ত্রের কথা শোনা যায়। কিন্তু এখন সেটিও নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ এখন মানুষ নির্বাচনের দিনও শান্তি মত ভোট দিতে যেতে পারে না। অনেকেই ভোটকেন্দ্রে যেতেও চায় না।’
গুণী এই রাষ্টবিজ্ঞানীর সদ্য প্রকাশিত ‘স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র’ গ্রন্থ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ গ্রন্থে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারের কার্যক্রম ও নীতিগত বিষয়াবলি আলোচনা করা হয়েছে। বর্তমানে গোটা জাতি যেসব সমস্যা মোকাবিলা করছে সেগুলো আমি আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। লেখাটির মাধ্যমে আমি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বিজয় দেখাতে চেয়েছি। সন্ত্রাস নিরসনে জাতীয় সমঝোতা কামনা করেছি। ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য আইন ও বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণ চেয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়াও বইটিতে দেশে বর্তমানে যে সাংবিধানিক সংকট, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব, মানবাধিকারের নাজুক অবস্থা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছি। সর্বোপরি আমি এ বইটিতে সমাজের বিদ্যমান সমস্যাগুলো তুলে ধরে সমাধান চেয়েছি।’
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তিনি মনে করেন একমাত্র গণতন্ত্রের মাধ্যমেই জাতীয় মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। তাই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম।
প্রসঙ্গত, ড. আবদুল লতিফ মাসুম বিগত চার দশক ধরে সমাজ ও রজনীতি বিষয়ে গবেষণা ও পাঠদান করে যাচ্ছেন। তিন বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক। এর আগে তিনি পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ পর্যন্ত তিনি ২০টি গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সমকালীন রাজনীতির ভাষা, জাতীয় ঐকমত্য ও উন্নয়ন সংকট, অসমাপ্ত রাজনৈতিক সংস্কার, বাংলাদেশ সমাজ ও রাজনীতি এবং পাশ্চাত্য রাষ্ট্র দর্শন।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন