১৯৯১-২০১৭। বেগম খালেদা জিয়া থেকে শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে অগ্রসরমান বাংলাদেশ। যে দেশ নারী শাসনেই পার করেছে ২৫ বছর-এক সিকি শতাব্দী। আর ১৩ পুরুষ মিলে বাকী বছরগুলো।
শাসনের ১৩ বছর শেখ হাসিনার। ১০ বছর খালেদা জিয়ার। আস্থার সংকটে অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা কেড়ে নিয়েছে আড়াই বছর।
১৯৭১-১৯৯১ পর্যন্ত পুরুষ নেতৃত্ব রাষ্ট্র পরিচালনা করে। যে সময়ে রাষ্ট্রিক পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ণ কেবল লোকদেখানো কথা।
পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশও প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। পুরুষ নেতৃত্বের চরম সংকটের মুখে নারীর উত্থান। নারী শাসিত দল ব্যবস্থার কারণে নারীপ্রধান রাষ্ট্রব্যবস্থার উৎপত্তি ঘটে।
বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির রাজনীতিতে নাম লেখান ১৯৮৪ সালে। স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হবার ৩ বছর পরে। নেতৃত্বের কোন্দলের মুখে।
শেখ হাসিনাও একই কারণে উঠে আসেন আওয়ামী লীগে-১৯৮১ সালে। বয়সে শেখ হাসিনার চেয়ে বেগম জিয়া প্রায় দুই বছরের বড়।
৩০ বছরের শাসনামলে নেতৃত্বে নারীর সংখ্যা ২ হলেও শাসক হিসেবে পুরুষের সংখ্যাটা কিন্তু ১৩। এঁদের ১১ জনই সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত হয়েছেন।
একটি মাত্র হত্যা কত বড় জাতীয় সংকটের কারণ হতে পারে নিশ্চয়ই আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না।
এরই মধ্যে নারী নেতৃত্ব এমন একটা স্তরে পৌঁছেছে , যে পুরুষ শাসিত ভবিষ্যৎ রাজনীতি এবং শাসন ক্ষমতা সুদূর পরাহত।
নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং ক্ষমতার লিপ্সা পুরুষকে রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্ব থেকে বিতাড়িত করেছে। পুরুষ পুরুষকে বিতাড়িত করেছে, নারীর কোন এতে ভুমিকা ছিল না। বরং নারীকে নেতৃত্বে পুরুষরাই টেনে এনেছে।
দুই নারীর জীবদ্দশায় কর্তৃত্বের ওপর হস্তক্ষের কারণ নেই, সম্ভাবনাও নেই।
নেত্রীদ্বয়ের অবর্তমানে কর্তৃত্বে পুরুষের উদয়ের আভাস বা উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা বলা হলেও তা কিন্তু কল্পনাপ্রসূত ‘আগামী’র কথা। বিরাজমান বাস্তবতা হচ্ছে নারী শাসিত দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সফল হয়েছে বার বার।
তৃতীয় দল জাতীয় পার্টির নেতৃত্বদানকারী পুরুষ এরশাদের এক হাত নিয়ে বিরোধী দলের নেতার আসনেও বসানো হয়েছে একজন নারী রওশন এরশাদকে। সুতরাং তাঁদের অবর্তমানে দুই দলের পুরুষরা নেতৃত্বের প্রশ্নে কতটা উদার মনস্ক ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবেন, সেটা বলা কঠিন। উদাহরণ হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পুরুষরা এক থাকতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বগ্রহণের আগেই আওয়ামী লীগ দুটি হয়েছে। কোন্দলের হাত থেকে বাঁচানোর তাগিদে উপদলীয় তৎপরতায় শেখ হাসিনার হাতে নেতৃত্ব তুলে দিয়েছেন। সেটাও যে ছিল স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য তা ১৯৮৩ সালে দলের সাবেক অস্থায়ী সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ ও তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক এবং তাঁদের অনুসারীরা মৃত বাকশালকে জীবিত করার মাধ্যমে প্রমান করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর আওয়ামী লীগ (মিজান) শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৫ দল থেকে গোপনে বেরিয়ে গিয়ে রাতারাতি এরশাদের ছাউনীতে ঢুকে পড়েন,এবং প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধুর আরেক মন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলীও এরশাদের মন্ত্রীবনে যান। আওয়ামী লীগ (ফরিদ গাজী) নামেও একটা দলের অস্তিত্ব সহ্য করতে হয় শেখ হাসিনাকে। ডঃ কামাল হোসেনও প্রেসিডিয়াম থেকে বাদ পড়ে গণফোরাম গঠন করেন। এই অবস্থা থেকে শেখ হাসিনাকে উঠে আসতে দুই যুগ পার করতে হয়েছে। তাই ভবিষ্যৎ
নেতৃত্বে নারীর বিকল্প পুরুষ হতেই পারে, তবে তা পরীক্ষা নিরীক্ষায় কাটাতে লাগবে অনেক বছর। তারপর তো সফলতার প্রশ্ন। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে ক্ষমতার হাতবদল হলেও পুরুষের গুণনে সংখ্যাটা অসংখ্য। যার শুরু তাজউদ্দীন আহমেদকে দিয়ে।
পরবর্তীতে ক্রমে রাষ্ট্রশাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, বিচারপতি আবু সা’দত মোহাম্মাদ সায়েম, জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসান উদ্দীন চৌধুরী ও জেনারেল হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ, বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি লতিফুর রহমান, অধ্যাপক ইয়াজ উদ্দীন আহমেদ, ডঃ ফখরুদ্দীন আহমেদ প্রমুখ। অর্থাৎ মোট তের পুরুষ।
বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন ব্যতীত সকলের শাসন ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত হয়েছেন। অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯১ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত শাসকরা রাষ্ট্রকর্তৃকই অবৈধ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যেমন তাদের ক্ষমতা উত্থান এবং পতন দু’ই অসাংবিধানিক ও অস্বাভাবিক।
“১৯২৬’র আগে নারীর ভোটের
অধিকারই ছিলনা”
১৯২৬ সালের আগে এ দেশে নারীর ভোটাধিকারই ছিল না। নারীকর্তৃক ইংল্যান্ড শাসনের শত বছর পার হলেও নারীর কোন ভোটাধিকার ছিল না। ১৯০৩ সালে চরম আন্দোলনের মুখে প্রথম নারীরা ভোটাধিকার অর্জন করে।
আর ব্রিটিশ শাসিত বাংলা তথা ভারতবর্ষে নারীরা ভোটাধিকার লাভ করে এর ২৩ বছর পর ১৯২৬ সালে।
এ জন্য নারীদের জেল, জুলুম, নিপীড়ন ও নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়। সারা পৃথিবীর চিত্র ছিল একই। বিশ শতকের পূর্বে কোন দেশেই নারীর ভোটাধিকার ছিল না। অথচ, পৃথিবী থেকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ চিরতরে উচ্ছেদ করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পুরুষ নারীকে দেবীর আসনে বসিয়ে পুজো দিত মূর্তি বানিয়ে। অথচ, সেই নারীকেই গণ্য করে কার্যত, ভোগের সামগ্রীরূপে।
আধুনিক গণতন্ত্রেও নারীরা ছিল অধিকার বঞ্চিত। খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি ও হিন্দু ধর্মে নারীর অধঃস্তন অবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়। ১৭ শতকে নারীরা ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলন রচনা করে এবং বিশ শতক পর্যন্ত দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
একমাত্র ইসলামে নারীর অধিকার স্বীকৃতি থাকলেও অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পিছিয়ে থাকে। মাতৃবংশানুক্রমিক সমাজ ব্যবস্থায় সমাজের কেবল নয়,পরিবারের প্রধান ও ছিলেন ‘মা।’ বংশানুক্রমে পরিবারের মেয়েরা হতেন শাসনকর্ত্রী। বিষয় সম্পত্তির শরিকানা ও সামাজিক পরিচয়েও মা’য়ের নামই ব্যবহার করতে হতো। সেই অর্থে সম্পত্তির কর্তৃত্ব ও বন্টনের নিয়ন্ত্রণও ছিল মা’য়ের হাতে।
সামন্ততান্ত্রিক উত্থান ঘটার পর ধর্মের দোহাই দিয়ে সেই শাসন ও পোষণ কর্তৃত্ব নারীর হাত থেকে কেড়ে নেয় পুরুষরা। নারীদের ক্ষমতাহীন করে ফেলে সর্বপর্যায়ে। নারীর সমস্ত ক্ষমতাকে কেড়ে নিয়ে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নানা বিধি নিষেধও তৈরি করে নারীর অধঃস্তন অবস্থার ভিত্তি স্থাপন করা হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন