ঐক্যবদ্ধ হয়ে বড় কোনো রাজনৈতিক জোট গড়তে না পারার বদনাম ঘুচাতে যাচ্ছে বাম দলগুলো। আগামী ডিসেম্বর মাসেই নতুন জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে যাচ্ছে সিপিবি, বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চাভুক্ত দলগুলো।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বাইরে আটটি বাম দলের ওই জোটের নাম ‘যুক্তফ্রন্ট’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর দেশের মূলধারার বাম দলগুলো এক ছাতার নিচে আসতে যাচ্ছে।
বেশ কয়েকটি বৈঠকের ধারাবাহিকতায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে এক বৈঠকে নতুন জোটের কর্মসূচি ও ঘোষণাপত্র তৈরির জন্য পাঁচ সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে কর্মসূচি ও ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে উত্থাপনের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ওই নেতারা জানান, প্রথম অবস্থায় সিপিবি, বাসদ (খালেকুজ্জামান) এবং গণতান্ত্রিক বাম মোর্চায় থাকা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন ও বাসদ (মার্ক্সবাদী)—এই আট দল মিলে নতুন জোট হবে। পরে আগামী নির্বাচনের আগেই আলোচনা সাপেক্ষে কাছাকাছি মতাদর্শের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল দলগুলোকে জোটে যুক্ত করা হবে।
বাম দলগুলোর কয়েকটি সূত্রে জানা যায়, জোট গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে ধারাবাহিক বৈঠকের অংশ হিসেবে গতকাল সেগুনবাগিচায় বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির কার্যালয়ে আট বাম দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বৈঠকে বসেন। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে আগামী দিনে জোটের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয় বৈঠকে।
পরে সিপিবি, বাসদ ও বাম মোর্চার প্রতিনিধি নিয়ে পাঁচ সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। উপকমিটি ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে জোটের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচিসহ একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করবে। এর পরই নতুন জোটের নাম চূড়ান্ত করে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে। তবে সে পর্যন্ত সিপিবি-বাসদ ও বাম মোর্চার ব্যানারে একসঙ্গে কর্মসূচি পালন অব্যাহত থাকবে। ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের প্রতিবাদে আগামী ৫ ডিসেম্বর সারা দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘেরাও ও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করা হবে। এর আগে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে ৩০ নভেম্বর হরতাল কর্মসূচি দিয়েছে সিপিবি, বাসদ ও বাম মোর্চা।
ঐক্যপ্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে একসঙ্গে রাজপথে নানা কর্মসূচি পালন করছি। এই প্রক্রিয়া আরো নিবিড় করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজপথেই আমাদের ঐক্য গড়ে উঠবে। ’
গতকালের বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিপিবি-বাসদ ও বাম মোর্চা মিলে একটি অভিন্ন কর্মসূচি নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী দিনে আন্দোলন ও নির্বাচন একসঙ্গে করার জন্য একটি ফ্রন্ট গঠনের বিষয়েও কথা হয়েছে। এই ফ্রন্টের নাম নিয়েও কথা হয়েছে, তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের বাইরে অন্য কোন কোন দলকে আমাদের জোটে সম্পৃক্ত করা যায় সেসব বিষয়েও আলোচনা চলছে। ’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত জুলাই মাস থেকে সিপিবি, বাসদ ও বাম মোর্চা পাঁচ দফার ভিত্তিতে একসঙ্গে কর্মসূচি পালন করে আসছে। এখন আমরা একসঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি গ্রহণ করতে যাচ্ছি। আশা করি, আগামী ডিসেম্বরেই আমাদের এই প্রক্রিয়া শেষ করতে পারব। ’
গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির আহ্বায়ক মোশরেফা মিশু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে মতপার্থক্য আছে বলেই তো আমরা পৃথক দল। কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে অনেক বিষয়ে ঐকমত্যও আছে। সে জন্য আমরা চেষ্টা করছি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি বড় জোট, বিএনপির নেতৃত্বেও একটি বড় জোট আছে। বাম কর্মীদের মধ্যেও দীর্ঘদিন ধরে একটি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে যে আমাদের নিজেদের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, মেহেনতি মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য নিজেরা কেন ঐক্যবদ্ধ হতে পারব না। আমাদের সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী যাঁরা আছেন তাঁদের মধ্যে থেকেও এক ধরনের চাপ ছিল যে বাম দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হোক। আমরা চেষ্টা করছি এই মুহৃর্তে জরুরি রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো এবং জনজীবনের সংকটগুলোকে একসঙ্গে করে একটি দাবিনামা ঠিক করতে। এর মধ্য দিয়ে আমরা একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের দিকে যেতে পারি। এই চিন্তা থেকেই জোট গঠনকে ত্বরান্বিত করতে আমরা ঘন ঘন বৈঠক করছি। ’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্য গ্রহণ করার জন্য একটি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। একসঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামের বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ’
জোটের নাম কী হবে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নেতা বলেন, ‘যুক্তফ্রন্ট নামটি একাধিক দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। নামের বিষয়টি পরে চূড়ান্ত করা হবে। ’
দীর্ঘদিন ধরে বহু আলোচনার মধ্য দিয়ে সিপিবি-বাসদ ও বাম মোর্চার নেতারা একটি জোট গঠনের বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হন। এখন জোটের নীতি, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কর্মসূচি চূড়ান্ত করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ জন্য দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা নিয়মিত বৈঠক করছেন। ঐক্য চূড়ান্ত রূপ দিতে ওই বাম নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য অনেক কমে এসেছে। যেসব বিষয়ে অমিল আছে সেগুলো নয়, যেসব বিষয়ে মিল রয়েছে সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে এক ছাতার নিচে আসতে চাইছে দলগুলো।
দলগুলোর সূত্রে জানা যায়, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ১০০ বছরপূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষে সম্প্রতি বাম দলগুলোর নেতাকর্মীরা এক মাসেরও বেশি সময় একযোগে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। ওই কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৭ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ এবং সমাবেশ-পরবর্তী বিশাল শোভাযাত্রা সারা দেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। সমাবেশে বক্তব্যে বাম সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বহুধাবিভক্ত বাম দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনের পরামর্শ দেন।
সূত্র মতে, জোট গঠনের প্রশ্নে বরাবরই আগ্রহী ছিল দেশের প্রাচীনতম বাম দল সিপিবি। কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলটির দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কারণে বাম মোর্চাভুক্ত একাধিক দল তাদের সঙ্গে জোট গঠনে রাজি ছিল না। তবে সাম্প্রতিক নানা আলোচনার মধ্য দিয়ে বাম মোর্চার ওই দলগুলো তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। এ ছাড়া গতকালের বৈঠকে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম স্পষ্ট বলেছেন, সরকার প্রশ্নে বাম মোর্চার যে অবস্থান, সিপিবির অবস্থানও তাই।
বাম দলগুলোর ঐক্যপ্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশের বাম দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজন ছিল। বাম দলগুলোর নিজেদের একেকটা গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য এবং নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে এ ঐক্য সম্ভব হচ্ছিল না। সম্প্রতি অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ উদ্যাপনের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাম নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। ’ তিনি বলেন, ‘এত দিন বাম দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে তেল-গ্যাস রক্ষাসহ বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে মানুষের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এই উপলব্ধি থেকেই বাম দলগুলো হয়তো তাদের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছে। ’
ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ দেশে পালাক্রমে দুটি দল শাসন করছে। আমরা বরাবরই চেয়েছি, এ দেশে একটি তৃতীয় বাম শক্তির বিকাশ হোক, সুস্থধারার রাজনীতির বিকাশ হোক। এ লক্ষ্যে বাম দলগুলোকে আমি বারবার আহ্বান জানিয়েছি। এখন তারা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, এটা ইতিবাচক। সময়ই বলবে তারা রাজনীতিতে কতটুকু অবদান রাখতে পারছে। ’ কালের কণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন