যৌতুকের আগুনে পুড়ছে হাজারো লিপি আক্তার
৮ নভেম্বর রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরে ২৫ বছরের লিপি আক্তারকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে হত্যার চেষ্টা করেন স্বামী জাহাঙ্গীর। লিপির মা হাজেরা বেগমের অভিযোগ, যৌতুকের জন্য জাহাঙ্গীর প্রায়ই লিপিকে মারধর করতো। কয়েকদিন আগে তাকে ৫৫ হাজার টাকা দিয়েছি। এখন ফের সে টাকা চাইছে। জাহাঙ্গীর টাকার জন্যই মেয়ের গায়ে কেরোসিন ঢেলে তাকে মারার চেষ্টা করেছে।
ফেনীর সোনাগাজীতে যৌতুকের টাকা না পেয়ে একই ভাবে স্ত্রী জেসনিকে হত্যার চেষ্টা করেছেন তার স্বামী। ২২ অক্টোবর রাতে উপজেলার চরমজলিশপুর ইউনিয়নের মজলিশপুর গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৪ বছর আগে জেসনি আক্তারের (২১) সাথে একই উপজেলার আনোয়ার হোসেনের (৩২) বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই তার উপর যৌতুকের কারণে নির্যাতন শুরু করেন স্বামী।
বগুড়ার কাহালুতে গত ১ আগস্ট ঘুমন্ত স্ত্রী শম্পা বেগমের (২০) গায়ে আগুন দেন স্বামী হূদয় হোসেন (২৬)। শম্পা বেগমের মা ও বাবার অভিযোগ, যৌতুকের কারণে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা প্রায়ই শম্পাকে নির্যাতন করতেন।
শুধু লিপি আক্তার, জেসনি আক্তার বা শম্পা বেগম নন, এমন যৌতুকের আগুনে পুড়েছেন আরো অনেক নারী। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে, গত অক্টোবর মাসে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩১ জন, তন্মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ১৫ জনকে। ‘আমরা পারি’ পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের জাতীয় সমন্বয়কারী জিনাত আরা হক জানান, ২০১৩ সালে প্রকাশিত দেশের সবক’টি বিভাগে করা তাদের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৯৫ দশমিক ৬৩ শতাংশর নারীর ওপর প্রতিনিয়ত যৌতুকের জন্য মানসিক চাপ দেওয়া হয়। ৯২ দশমিক ৯২ শতাংশ নারীকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে স্বামীরা। শারীরিক নির্যাতনের শিকার নারীদের ৯৩ দশমিক ১৩ শতাংশকে লাথি ও আঘাত করা হয়েছে। স্বামীর হাতে লাঠির মার খেয়েছেন ৯১ দশমিক ২৫ শতাংশ স্ত্রী।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে যৌতুকের জন্য ১৭৩ জন নারী খুন হয়েছেন। নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৬২টি। আর গত ৫ বছরে এ সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। হত্যার শিকার হয়েছেন ১ হাজার ২৬৫ জন নারী। মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু ইত্তেফাককে বলেন, সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে যৌতুক নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। শিক্ষিত পরিবারও যোগ্য মেয়েকে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিচ্ছে, ফলে তা অন্যদের মধ্যে প্রভাবিত হচ্ছে। এর পেছনে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার না থাকা, বাল্য বিবাহ, নারীর সামাজিক মর্যাদা না থাকা, যৌতুক দেওয়াকে স্ট্যাটাস মনে করাকে দায়ী করেন তিনি। তিনি বলেন, যৌতুক দেওয়া এবং নেয়া উভয়ই যে মর্যাদাহানিকর এখন আর কেউ মনে করে না। যৌতুকের বিরুদ্ধে আইন আছে কিন্তু সেভাবে তা বাস্তবায়ন হয় না। ফলে যৌতুক পারিবারিক সহিংসতার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত অক্টোবর মাসে পারিবারিক নির্যাতনে ২৮ জন নারীকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে স্বামীর হাতে খুন হন ১৬ জন নারী। এছাড়া জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যৌতুকের জন্য ৯৬ জন নারীকে হত্যা করা হয় এবং ৩ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। এসবের পেছনে যৌতুক অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করেন কেন্দ্রের সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর নিনা গোস্বামী। তিনি বলেন, যৌতুকের কারণে সহিংসতার মামলা হলে অনেক সময় বিচারকই বলেন আপস করে নিতে। এতে অপরাধীর শাস্তি হয় না। এটা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। নিনা বলেন, যৌতুক নিরোধ আইন আছে, আছে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন। সরকার আবার নতুন আইন করার কথা ঘোষণা করেছে। তবে শুধু আইন করলেই হবে না যৌতুক বন্ধে পারিবারিক সচেতনতার উপর জোর দিতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে পাঠ্যবই ও গণমাধ্যমে প্রচারণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে নির্যাতনের শিকার হন মোট ৩৮৬ জন নারী। এদের মধ্যে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ২০৩ জন নারীকে। যৌতুকের কারণে ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ২৩৬ জন নারীকে। ২০১৩ সালে হত্যা করা হয়েছে ২৪৫ জন নারীকে। আর ২০১২ সালে হত্যা করা হয় ১৯৭ জনকে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন