সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে আওয়ামী লীগের শরিকদের বিজয়ী আসনগুলো এবার হাতছাড়া হতে পারে। পাশাপাশি এসব আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। খোদ ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূল নেতারা এমন আশঙ্কা করছেন। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে কিন্তু নির্বাচনের আগে সবাই দলের সিদ্ধান্ত্ম মেনে নেবে। প্রার্থীদের টানাপড়েন ফলাফলে প্রভাব ফেলবে না।
সূত্র জানায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে শরিক এমপিদের সম্পর্ক দা-কুড়াল। দলটির প্রার্থীরা চান না শরিকদের কেউ ফের এমপি হোক। কারণ এমপি হলে আগামীবারের জন্যও তিনি মনোনয়ন থেকে বাদ পড়বেন। আর শরিক প্রার্থী পরাজিত হলে পরের বার মনোনয়ন নিয়ে সমস্যা হবে না। এ অবস্থায় উভয়ের রেশারেশিতে বিএনপি প্রার্থীরা শরিকদের আসনুগলোতে সহজেই জয়লাভ করবেন বলে ধারণা করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
রাজনৈতিক বিশেস্নষকদের মতে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে রাজনীতির যে সমীকরণ দাঁড়াবে, তাতে বিএনপির মতো জনপ্রিয় দলের প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের অসহযোগিতা ও বিদ্রোহী প্রার্থীকে মোকাবেলা করে ক্ষমতাসীন মহাজোট শরিক সাংসদদের দুই-একটি আসন বাদে সবগুলোতেই পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের মতে, দল এবার শরিকদের মনোনয়ন সংখ্যা না কমালে ভুল করবে। কারণ এমনিতে বর্তমান এমপিদের এলাকাতে অস্ত্মিত্ব নেই, আর গতবারের মতো এবার নির্বাচন হবে না। এমপিরা দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করায় তাদের পক্ষে কেউ কাজ করবে না। আওয়ামী লীগ এমপি প্রার্থীরাও তাদের সহযোগিতা করবে না; সে সুযোগে বিএনপি প্রার্থীরা সহজেই ওইসব আসনে জয় ছিনিয়ে নেবে।
নেতারা আরো বলেন, আওয়ামী লীগের উপর ভর করে শরিক দলের নেতারা এমপি হয়েছেন। ফলে দলের প্রার্থীদের কপাল পুড়েছে। তারা এবার নির্বাচনের জন্য জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন,
দলীয় মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবেন। তারা জানেন এমপিরা জয় পাবে না, কারণ তারা অস্ত্মিত্বহীন। নিজেদের নেতাকর্মী নেই, আওয়ামী লীগ কর্মীরা কাজ না করলে তারা পাস করবেন না।
এছাড়া শরিক প্রার্থীরা জয়লাভ করম্নক তা চায় না আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। কারণ একবার এমপি হলে পরবর্তীতে সে আসনের জন্য দল তাকেই চিন্ত্মা করে। আর হারলে পরবর্তীতে তারা দল থেকে নির্বাচনের সুযোগ পাবে। তাই এবার আর ভুল করতে চান না আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। এমন পরিস্থিতিতে একাদশ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীরা সহজে জয়লাভের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
সূত্র জানায়, সাংসদদের স্বেচ্ছাচারিতা, আত্মীয়করণ ও নানাভাবে আওয়ামী লীগ নেতাদের বঞ্চিত করার কারণে স্থানীয় নেতাকর্মীরা মারমুখী অবস্থানে রয়েছেন। সাংসদরা নিজস্ব গ-ির বাইরে এমপিরা কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেন না। এলাকার লোকজন এমপিদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বিভিন্ন কাজে। নেতারা জানান, জনগণের সব দাবি থাকে আওয়ামী লীগের কাছে।
এ অবস্থায় দলের ওপর ভর করে জয়ী হওয়াকে আসনগুলোর সাবেক আওয়ামী লীগের সাংসদরা এবার আর মেনে নিতে পারছেন না। নেতারা বলেন, 'এলাকার লোকজন আমাদের চিনে, শরিক সাংসদরা কাজ না করায় আমাদের ইজ্জত ও আওয়ামী লীগের ফিল্ড নষ্ট হয়েছে। তাই তারা এবার জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং এলাকায় ঘোষণা করছেন দলের মনোনয়ন না পেলে তারা বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করবেন। সেজন্য জোটের এই পরিস্থিতিতে বেশ চিন্ত্মিত শরিক সাংসদরা।'
আবার অনেক আসনে এমপিরা শুধু নামেই আছেন; বাহ্যিকভাবে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগের হাতে। স্থানীয় নেতারা পাশে না থাকলে এমপিরা এলাকায় ঢুকতে পারবে না বলে মন্ত্মব্য অনেক নেতার। কিন্তু কেন্দ্রীয় নির্দেশনার কারণে আওয়ামী লীগ নেতারা প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন না।
তবে সম্প্রতি কুষ্টিয়ার-২ আসনের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ ও জাসদ একাংশের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা চাচ্ছেন না এই আসন থেকে ইনু ফের পাস করে সংসদে যান। এ ছাড়া অন্য অনেক আসনে শরিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়ে সংঘর্ষও হতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেক নেতা।
কুষ্টিয়ায় এক সমাবেশে হাসানুল হক ইনুকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, 'ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার।' এর পরদিন কুষ্টিয়ায় জাসদের সমাবেশে ইনু বলেন, 'তারা সংখ্যায় বিপুল না হলেও তাদের ছাড়া 'হাজার বছরেও' আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আপনারা ৮০ পয়সা থাকতে পারেন। আপনি এক টাকার মালিক না। যতক্ষণ এক টাকা হবেন না ততক্ষণ ক্ষমতা পাবেন না। আপনি ৮০ পয়সা আর এরশাদ, দিলীপ বড়ুয়া, মেনন আর ইনু মিললে তবেই এক টাকা হবে। আমরা যদি না থাকি তাহলে ৮০ পয়সা নিয়ে আপনারা (আ'লীগ) রাস্ত্মায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরবেন। এক হাজার বছরেও ক্ষমতার মুখ দেখবেন না।'
এছাড়া এর আগে এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের 'ষড়যন্ত্রকারীদের একজন' আখ্যায়িত করেছেন জাসদের অপর অংশের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক শরীফ নুরম্নল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধান। আগামীতে এর প্রভাব নির্বাচনে পড়বে।
এদিকে অনেক আসনেই আওয়ামী লীগ ও শরিকদের মাঝে অন্ত্মর্দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। ঢাকা-৮ আসনের সাংসদ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এ আসনে নির্বাচন করতে প্রচারণা চালাচ্ছেন বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা যায়যায়দিনকে বলেন, দীর্ঘদিনেও এই এলাকায় তিনি কোনো অবস্থান তৈরি করতে পারেননি। তাদের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ঢাকার নির্বাচন সরাসরি কেন্দ্র থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তাই তারা কিছু করতে পারেন না। তবে তার পক্ষে নেতাকর্মীদের কাজ করানো তাদের জন্য কষ্টকর হবে।
ফেনী-১ এর সাংসদ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফেনীর জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, এ আসন থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন করেন। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে দলের শক্তিশালী প্রার্থীরও জয়ের সম্ভাবনা নেই, সেক্ষেত্রে জাসদ তো হিসাবের বাইরে। আর অন্য দলের প্রার্থীর জন্য তাদের নেতাকর্মীরা কেনই বা পরিশ্রম করবে যিনি তাদের সঙ্গে সম্পর্কই রাখেন না।
নড়াইল-২ এর সাংসদ ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ হাফিজুর রহমান। আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক রাশিদুল বাশার ডলার যায়যায়দিনকে বলেন, গতবারের মতো নির্বাচন যদি না হয় তাহলে বর্তমান এমপির জয়লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। জয় পেতে হলে জোট থেকে অবশ্যই আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে হবে। তিনি বলেন, এ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। তারা পাস করলেও দুই-তিন হাজারের বেশি ভোট পাননি। সেক্ষেত্রে শরিক দলের প্রার্থী মনোনয়ন দিলে বিএনপিকে পাস করতে বেগ পেতে হবে না।
দেশের অন্যান্য জেলায় জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতাসীনরা ছাড় দিলেও রংপুর অঞ্চলে এবার ছাড় দিতে নারাজ। জাতীয় পার্টির পরিবর্তে রংপুরকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বানাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। কুড়িগ্রাম-৪ এর সাংসদ জাতীয় পার্টির (জেপি) রম্নহুল আমিন। এখানকার আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, জোটের মনোনয়ন পেলেও তিনি এবার জয়লাভ করতে পারবেন না। কারণ প্রথমত, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের কাজে লাগাতে পারবেন না অতীতে তিনি যোগাযোগ রক্ষা না করার জন্য। দ্বিতীয়ত, জাতীয় পার্টিরও আলাদা প্রার্থী থাকবে বিধায় তারা ছাড় দেবে না, আর বিএনপি তো বিরোধী হিসেবে নির্বাচন করবেই। তাই ত্রিমুখী লড়াইয়ে জয়লাভের জন্য আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রয়োজন এ আসনে।
এ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি জাকির হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, জাতীয় পার্টির ঘাঁটিকে তিনি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বানিয়েছেন। গত নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। এবার বর্তমান এমপির পাস করার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে হাফিজুর রহমান এবার আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।
এছাড়া জাসদের পঞ্চগড়-১, বগুড়া-৪, চট্টগ্রাম-৮ আসন; তরিকত ফেডারেশনের চট্টগ্রাম-২ ও লক্ষ্ণীপুর-১ আসন; ওয়ার্কার্স পার্টির ঠাকুরগাঁও-৩, রাজশাহী-২, সাতক্ষীরা-১ আসন ও জাতীয় পার্টির (জেপি) পিরোজপুর-২ আসনে নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। প্রার্থীদের মতে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হলে এসব আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনা বেশি। তাই জয়ের জন্য অবশ্যই আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রয়োজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, জোটের প্রার্থীদের ছাড় দেয়া হবে। তবে কাউকে কোনো আসনে এককভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে দেয়া হবে না।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, নির্বাচনের এখনো অনেক দেরি। দল ও জোটের সব প্রার্থী নিজেদের মতো প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবেই। এতে চিন্ত্মার কিছু নেই। মনোনয়ন দেয়ার পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
দলের সভাপতিম-লীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারম্নক খান যায়যায়দিনকে বলেন, দল থেকে জনপ্রিয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া হবে। জোটের ক্ষেত্রেও একই বিষয় বিবেচনা করা হবে। জয়লাভের ব্যাপারে তারা সর্বোচ্চ আন্ত্মরিক। এজন্য সবাই নিজের জনপ্রিয়তা দেখানোর চেষ্টা করছেন; তবে মনোনয়ন দেয়ার পর প্রার্থীদের মধ্যে সমস্যা থাকবে না। আর সমস্যা সমাধানে ও দলীয় শৃংখলা রক্ষায় আমরা কঠোর হবো।
এ বিষয়ে জাসদ একাংশের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার বলেন, জোট করা হয়েছে বৃহত্তর স্বার্থে। একদল আরেক দলের দ্বারা উপকৃত হওয়ার জন্য। শরিক দলগুলো ছোট বিধায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে গেছে। এখন তারা অসহযোগিতা করলে তো আর জোট হলো না।
যায়যায়দিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন