বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ায় নাগরিক সমাবেশের আয়োজন করে নাগরিক কমিটি। সোহরাওয়ার্দীর উদ্যানের এই সমাবেশে নাগরিক কমিটির ব্যানারে করা হলেও মূল আয়োজক ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
.
নাগরিক সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। গত ১২ নভেম্বর বিএনপির সমাবেশের বিপরীতে আজকের সমাবেশকে পাল্টা শোডাউন হিসেবে দেখা হচ্ছিল। ঢোল-তবলা আর নৌকা প্রতীক নিয়ে সমাবেশে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিপুল উপস্থিতি তা-ই প্রমাণ করেছে।
সমাবেশ ঘিরে তাই ধারণা করা হচ্ছিল- আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দলের অবস্থা পুনর্ব্যক্ত করবেন প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি নেতাকর্মীদের দেবেন দিকনির্দেশনাও।
তবে অনেকটা অবাক করে দিয়ে নাগরিক সমাবেশে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্যই দেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছিল না বিএনপি এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে সচরাচর করা সমালোচনাও।
সমাবেশে মাত্র ২৫ মিনিট বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। বক্তব্যের বেশিভাগ জুড়েই ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তৎকালীন প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা এবং স্বাধীনতার ইতিহাস ‘বিকৃতি’ প্রসঙ্গ।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় বক্তব্যের শুরুতেই ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলাদেশ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এজন্য আমরা গর্বিত জাতি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের উন্নত শির যেন আর কোনোদিন পরাভূত না হয় সেজন্য সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত থাকবে। এর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি এগিয়ে যাবে- এটাই হোক আজকের প্রতিজ্ঞা।’
তিনি বলেন, ‘ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাসহ সবাই সম্মানিত হয়েছেন। পৃথিবীর কোনো ভাষণ ৭ মার্চের ভাষণের মতো এতোদিন, এতোঘণ্টা ধরে বাজেনি।’
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘অনেক রাষ্ট্রনায়কের ভাষণ ইতিহাসে ঠাঁই পেলেও সেগুলো আগেই লেখা ছিল। ৭ মার্চের ভাষণ এমন একটি ভাষণ যার লিখিত কিংবা কোনো নোটও ছিল না। ভাষণ দেওয়ার আগে পায়চারীর সময় আমার মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেছিলেন- তোমার মনে যে কথা আসবে, তুমি শুধু সেকথাই বলবে। কারণ তুমি জানো- তোমার কী কথা বলতে হবে বাঙালি জাতির জন্য।’
তিনি বলেন, ‘যারা বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন, স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি করেছিলেন তারা কারা? তারা তো চাটুকার, পাকিস্তানের প্রেতাত্মা। তাদের লজ্জা হয় না। আমি জানি তাদের কোনো লজ্জা নেই।’
অবশ্য আগামী নির্বাচন ও বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সবার কাছে আমার একটা অনুরোধ- আর যেন কখনো ওই পাকিস্তানি প্রেতাত্মা, তোষামোদী চাটুকারী দল যেন বাংলার মাটিতে ফিরে আসতে না পারে। আর যেন তারা ইতিহাস বিকৃতি করার সুযোগ না পায়। এজন্য বাংলাদেশের সকল মানুষকে জাগ্রত থাকতে হবে।’
এবিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতায় কোনো রাজনৈতিক বিষয় না থাকা অত্যন্ত সাধারণ। এর মাধমে তিনি তার পিতার আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এই সমাবেশ ছিল আপামর সাধারণ মানুষের। কারণ শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ মানবজাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ১০০ ভাষণের মধ্যে স্থান পাওয়া দেশের মানুষের জন্য অসাধারণ সম্মানের। জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু তা প্রতিটি মানুষকে জাগ্রত করেছিল। স্বাধীনতার সময় তো কোন দল বা গোষ্ঠী ছিল না। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। তাই এই ভাষণটিকে রাজনৈতিকীকরণের কোনো সুযোগ নেই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের আন্তর্জাতিক ইতিহাসের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এ বিষয়ে পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলার, কোন দলের বা মহলের ছিলেন না। আজ তার সেই স্বাধীনতার আহ্বানের ভাষণ স্বীকৃতি পাওয়ায় সমগ্র জাতি গৌরবান্বিত বোধ করছে। সুতরাং, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে রাজনৈতিক কোনো দিক না থাকা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানানো ছাড়া অন্য কিছু নয়।’
জানতে চাইলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে বক্তৃতা দিয়েছেন, তা থেকে অন্যদের শিক্ষা নেয়া উচিত। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণটি এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে তিনি বাংলার মানুষের এবং দেশের জন্য তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। তিনি এই ভাষণ লিখে, শিখে দেননি। তার মনের কথাগুলোই তিনি (বঙ্গবন্ধু) তুলে ধরেছিলেন। দেশের জন্য তার আত্মত্যাগের প্রতিদান আজ এই স্বীকৃতির মাধ্যমে হয়েছে। তাই এই বিষয়টি রাজনীতির ঊর্ধ্বে।’
এর আগে শনিবার দুপুর আড়াইটার পরে প্রধানমন্ত্রী সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন। এসময় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অংশ বিশেষ মাইকে বাজানো হয়। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সমাবেশ। বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে শুরু করে ৪টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন