সুন্দরবন সংলগ্ন দেশের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর মোংলা ও চিংড়ি উৎপাদনের বৃহৎ এলাকা রামপাল উপজেলা নিয়ে বাগেরহাট-৩ আসন গঠিত।
ভৌগোলিক কারণে দেশের অর্থনীতিতে রয়েছে এ অঞ্চলের বিশেষ ভূমিকা। মোংলা ও রামপালকে ঘিরে অর্থনৈতিক জোন তৈরির কাজ চলমান। তাই এ আসন ঘিরে আগ্রহ সব দলের প্রার্থীদেরই রয়েছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে জয়ী হতে বিএনপি-জামায়াত তাই একাট্টা হয়ে কাজ করছে। তবে বর্তমান সংসদ সদস্য তালুকদার আবদুল খালেকের বিপক্ষে ভোটযুদ্ধে অংশ নিয়ে বিএনপির প্রার্থী কতখানি সফল হয় সেটি দেখার বিষয়।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কুবের চন্দ্র বিশ্বাস ৪৫ হাজার ৪৮৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। এ সময়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যাপ ভাসানীর প্রার্থী শেখ আমদাজ আলী পান ২১ হাজার ২৪৮ ভোট।
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের লতিফুর রহমান হাওলাদার বিএনপি প্রার্থী আফতাব উদ্দিন হাওলাদারের কাছে পরাজিত হন। বিএনপির আফতাব উদ্দিন পেয়েছিলেন ২৮ হাজার ৮১৩ ভোট আর লতিফুর রহমান পেয়েছিলেন ২৬ হাজার ৪১৭ ভোট।
এরপর ১৯৮৬ সালে বিএনপির আফতাব উদ্দিন হাওলাদার জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগের মনোজিৎ মণ্ডলকে পরাজিত করে দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থী গাজী আবু বক্কর সিদ্দিককে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক এমপি নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে বিনা ভোটে বিএনপির প্রার্থী এ ই ইউ আহমেদ কয়েক মাসের জন্য এমপি নির্বাচিত হন।
পরবর্তীকালে একই বছরের ১২ জুন সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তালুকদার আবদুল খালেক পুনরায় জামায়াত নেতা গাজী আবু বক্কর সিদ্দিককে পরাজিত করে দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হন।
২০০১ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তালুকদার আবদুল খালেক জয়ের ধারা অব্যাহত রাখেন।
সেবারও তিনি জামায়াত নেতা গাজী আবু বক্কর সিদ্দিককে পরাজিত করেন। ২০০৮ সালে তালুকদার আবদুল খালেক খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র থাকায় তার স্ত্রী হাবিবুন্নাহার তালুকদার প্রার্থী হয়েও জামায়াত নেতা আবদুল ওয়াদুদকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন।
সর্বশেষ ২০১৪ সালের আলোচিত সংসদ নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তালুকদার আবদুল খালেক বাগেরহাট-৩ আসনের এমপি নির্বাচিত হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের রয়েছে শক্ত অবস্থান।
এর বাইরে এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র নেতা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাব-কমিটির সাবেক সহসম্পাদক ব্যারিস্টার শেখ ওবায়দুর রহমান ওবায়েদ। তিনি রামপাল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুল ওহাবের ছেলে।
অপরদিকে বাগেরহাট-৩ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র নেতা সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও বাগেরহাট জেলা বিএনপির সহসভাপতি ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম। ইতিমধ্যে তিনি তার ক্লিন ইমেজ দিয়ে নিজ এলাকায় অবস্থান তৈরি করেছেন।
এ আসনের অন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন জেলা বিএনপির অপর সহসভাপতি সরদার মো. অজিয়ার রহমান, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা বাবু ছাড়াও জামায়াত নেতা শেখ আবদুল ওয়াদুদ।
রামপাল-মোংলার উন্নয়নের রূপকার দাবিদার তালুকদার আবদুল খালেক যুগান্তরকে বলেন, ‘দক্ষিণাঞ্চলের যা উন্নয়ন হয়েছে তা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের মৃত মোংলা বন্দর এখন কর্মচঞ্চল।
মোংলা-ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌচ্যানেল খনন, মোংলা বন্দরের আধুনিকায়ন, খুলনা-মোংলা রেললাইন, খানজাহান বিমানবন্দর নির্মাণ, রামপালে কয়লাভিত্তিক আধুনিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অসংখ্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও ত্যাগের পর আজ সারা দেশের মতো রামপাল-মোংলাকে বর্তমান সরকার যেভাবে সাজাতে শুরু করেছে তাতে বিএনপি-জামায়াতের ঈর্ষান্বিত হওয়ার কথা। কারণ ওনারা দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।’
এ আসনে আওয়ামী লীগের অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ব্যারিস্টার ওবায়দুর রহমান ওবায়েদ বলেন, ‘আমি রাজনৈতিক সততায় বিশ্বাস করি। সংসদ সদস্য পদ কারও আয়ের উৎস হতে পারে না। রামপাল-মোংলা নিয়ে আমার উদ্দেশ্য যদি সৎ হয়, একদিন আমি সফল হবই ইনশাআল্লাহ।’
জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মোংলা সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, ইপিজেড ও সুন্দরবনকেন্দ্রিক ইকো-ট্যুরিজমের মাধ্যমে এ এলাকার উন্নয়নে কাজ করার ভালো সুযোগ রয়েছে।
এসব প্রকল্প নিয়ে কাজ করলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমার রাজনৈতিক, পেশাগত ও সামাজিক কাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেশের কল্যাণে অবদান রাখতে পারব।’
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী বাগেরহাট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা বাবু বলেন, ‘দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের কাছে অন্য প্রার্থীর চেয়ে আমি অনেক বেশি পরীক্ষিত। বাগেরহাট-৩ আসনে বিএনপি-জামায়াতের রয়েছে শক্ত অবস্থান।
এখানে দলের সাংগঠনিক অবস্থা অত্যন্ত মজবুত। আমি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘দলীয় সাংগঠনিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে আমার দলের নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। আমার ঘাড়েই ৭টি নাশকতার মামলা রয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বাগেরহাট-৩ আসনে আমি জয়ী হব আশা করি।’
জামায়াত যেহেতু সরাসরি একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, সে প্রেক্ষিতে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকলে সহজেই জয় পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী আলী রেজা বাবু।
বিএনপির অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা বিএনপির সহসভাপতি সরদার মো. অজিয়ার রহমান বলেন, ‘আমি রামপাল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছি। দলীয় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ড করে আসছি।’ তিনি দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন