নাগরিক সুবিধার পরিবর্তে ভোগান্তি ও সংকটে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে রাজধানী ঢাকা। এক মশার কারণেই অতিষ্ঠ নগরবাসী। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রতিদিনের অসহনীয় যানজট। এ যানজটকে দুর্বিষহ করে তুলছে নিত্যনতুন উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়ি। আছে অল্পবৃষ্টিতেই তৈরি হওয়া জলাবদ্ধতা এবং প্রায়ই বিভিন্ন স্থানে দেখা দেওয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পানি ও গ্যাসের সংকট। নগরসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীবাসীর তীব্র ভোগান্তির নেপথ্য কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ণ। সেই সঙ্গে পরিস্থিতির উত্তরণে তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকায় ভোগান্তি কবে শেষ হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। নগরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদক কথা বলেছেন, ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বিষয়টি নিয়ে গতকাল কথা বলতে পারেননি। তবে কয়েক দিন পর তিনি বিস্তারিত বলবেন বলে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। সরেজমিন দেখা গেছে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে মিরপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ৩০ মিনিটের রাস্তা যেতে ২ ঘণ্টারও বেশি লাগছে। দেখা গেছে, মেট্রোরেলের প্রথম পর্যায়ের কাজ চলছে উত্তরা, মিরপুর, পল্লবী, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও। এসব এলাকায় মেট্রোরেল লাইন-৬-এর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। প্রথম পর্যায়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে চালু হবে মেট্রোরেল। এর মধ্য দিয়ে মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করবে রাজধানী ঢাকা। আর ২০২০ সালে লাইন-৬-এর পুরো সুবিধা মিলবে একেবারে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত। এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের পাশাপাশি দ্বিতীয় অংশের কাজও চলছে। আগারগাঁও থেকে ফার্মগেট, বাংলামোটর, শাহবাগ, পল্টন ও মতিঝিল পর্যন্ত এ কাজ চলছে। এসব এলাকায় যানজট চরম ভোগান্তির সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে মেট্রোরেলের মতো ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজও চলছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রাজধানীর যানজট ৩০ ভাগ কমবে। ২০২১ সালের মধ্যেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা ভোগ করবে রাজধানীবাসী। এলাকাবাসীর অভিযোগ, উন্নয়ন কর্মকান্ডে র পরিকল্পনায় নগরবাসী খুশি হলেও উন্নয়ন-ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের। প্রশ্ন উঠেছে, বছরের পর বছর ধরেই যদি উন্নয়ন কর্মকা চলে মানুষ এর সুফল পাবে কখন? রাজধানীতে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজসহ বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়নকাজ চলছে। সেই সঙ্গে পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেনেজ নির্মাণ, ফুটপাথের উন্নয়নকাজ, স্যুয়ারেজ লাইন, সড়ক সংস্কার, ওয়াসা, ডেসা ও তিতাসের সংযোগ লাইন স্থাপনসহ বছরজুড়েই বিভিন্ন কারণে নগরীর সড়কগুলোয় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। সড়কগুলো কেটে ফেলায় ভোগান্তির মাত্রা কয়েক গুণ বেড়েছে। বৃষ্টি হলেই নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের অলিগলিতে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এসব সড়ক দিয়ে পথচারীদের চলাচলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। উঁচু-নিচু সড়ক দিয়ে যানবাহনের চাকার সঙ্গে কাদা-মাটি পথচারীদের জামাকাপড় ও আশপাশের দোকানগুলোয় গিয়ে পড়ছে। বছর ধরে উন্নয়নকাজের নামে খোঁড়াখুঁড়ি চলতে থাকায় পরিস্থিতিকে তা আরও নাজুক করে তুলছে। রোদ থাকলে ধুলা আর একটু বৃষ্টি হলেই কাদা। দেখা দেয় জলাবদ্ধতাও। বর্ষা মৌসুম এলে পরিস্থিতি যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলাই বাহুল্য। যানজট, ধুলো-দূষণে নগরবাসী এমনিতেই অতিষ্ঠ। এখন উন্নয়ন কর্মকান্ডে র কারণে তাদের ভোগান্তি যেন চরমে না পৌঁছে সেটি নিশ্চিত করতে হবে যে কোনো মূল্যে।
যানজট বাড়াচ্ছে মানসিক অসুস্থতা : যানজটের কারণে রাজধানীতে একটি গাড়ি ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে মাত্র ৫ কিলোমিটার। যানজটের কারণে বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এ পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে থাকবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার ফলে যাত্রীদের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি বাড়ছে মানসিক চাপও। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘সবাই চায় কাজ করে সুন্দর জীবন নির্বাহ করতে। কিন্তু যানজটের কারণে তা পারে না। তারা পরিবার, সন্তান ও আত্মীয়স্বজনদের ঠিকমতো সময় দিতে পারে না। ফলে মানসিক সুস্থতা ও বিকাশ থেমে থাকছে। এতে সব সম্পর্কেই বিরূপ প্রভাব ফেলে।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় বড় সড়কের সংখ্যা হাতে গোনা। ট্রাফিক মোড়গুলো শহরের বিষফোঁড়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সড়কে অবৈধ পার্কিং, ফুটপাথের অবৈধ দখল, ভাসমান বিক্রেতাদের সড়ক দখল, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো, খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সড়কের প্রশস্ততা কমে যাওয়া।
গ্যাস সংকটে জ্বলছে না চুলা : তীব্র গ্যাস সংকটে রাজধানীর অনেক এলাকায় জ্বলছে না চুলা। তাই পাল্টে গেছে জীবনের রুটিন। রমজানের আগেই সমস্যার সমাধান চান ভুক্তভোগীরা। একই সঙ্গে নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ারও সমালোচনা করেছেন তারা। রাজধানীর বিমানবন্দরসংলগ্ন কাওলা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, উত্তরা, মিরপুর, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, কেরানীগঞ্জ, কলাবাগানসহ আরও কিছু এলাকায় অনেক দিন ধরেই চলছে গ্যাসের সংকট। কখনো গভীর রাতে চুলা জ্বললেও তা কোনো কাজেই আসে না রাজধানীর মানুষের। দাম বাড়ানোর আগে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান চান ভুক্তভোগীরা। সমস্যা সমাধানে কথা বলতে নারাজ তিতাসের কর্মকর্তারা। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিকল্প ব্যবস্থা করতে না করলে ভবিষ্যতে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। রমজান শুরুর আগেই সমস্যার সমাধান চান নগরবাসী।
পানযোগ্য পানির হাহাকার : ঢাকা ওয়াসা দাবি করে, রাজধানীতে পানির সংকট নেই। কিন্তু এ দাবির সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। অনেক এলাকায় পানি থাকলেও নেই বিশুদ্ধ পানি। বাসাবাড়িতে ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করে, তা নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে রাজধানীর বাসাবো, কদমতলী, টিটিপাড়ার অনেকেই ওয়াসার কাছ থেকেই বিশুদ্ধ পানি কিনে খাচ্ছেন। রাজধানীর অনেক বাসিন্দাকেই পানির জন্য বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। যাদের কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের অবস্থা শোচনীয়।
বাতাসে বহুমুখী দূষণ : ধুলাবালি, গাড়ির হাইড্রলিক হর্ন থেকে শুরু করে নানারকম শব্দদূষণ, গাড়ির কালো ধোঁয়া, বাসাবাড়ির বর্জ্য, মেডিসিন বর্জ্য, ই-বর্জ্যসহ বিভিন্ন দূষণে একাকার রাজধানী ঢাকা। সবকিছুকে ছাপিয়ে রাজধানীর বিস্তীর্ণ এলাকা এখন ধুলো-দূষণে ছেয়ে গেছে। দিনের বেলায়ই ঢাকার আকাশ অন্ধকার হয়ে যায় ধুলোর কারণে। বাতাসে উড়তে থাকা ধূলিকণা বাসাবাড়িতে প্রবেশ করছে। ফলে নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে দিন দিন। শ্বাসকষ্ট, হাঁচি, কাশি থেকে শুরু করে নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন নগরের বাসিন্দারা। একদিকে নগরীর অনেক এলাকা জুড়ে চলছে সরকারের উন্নয়নকাজ, অন্যদিকে বাসাবাড়ি নির্মাণকাজও চলছে সমানে। এ কারণে নগরীর মিরপুর, আগারগাঁও, পল্লবী, ফার্মগেট, বাংলামোটর, মতিঝিল, পল্টন, বিমানবন্দর সড়ক, যাত্রাবাড়ী, চিটাগাং রোড, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়নকাজ চলায় ধুলাবালিতে সয়লাব।
তীব্র শব্দে কান পাতা দায় : প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় যানবাহনের শব্দদূষণে অতিষ্ঠ নগরজীবন। রাস্তায় নামলেই কারণে-অকারণে যানবাহনগুলো দেদার গাড়ির হর্ন বাজানোর কারণে মানুষকে এ যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে প্রতিদিন। গাড়ির হর্নের পাশাপাশি অকারণে কিছুসংখ্যক গাড়ি অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন, পুলিশের গাড়ির সাইরেনসহ নানারকম শব্দ বাজিয়ে শাঁ শাঁ করে রাস্তায় চলাচল করে; যা শব্দদূষণ তৈরি করে। এসব কারণে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হন।
দায় আছে নগরবাসীরও : সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও সিটি করপোরেশন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকাবাসীর অসচেতনতা, দায়িত্বহীনতা, অসাবধানতাই রাজধানীর পরিবেশ বিনষ্টের জন্য অনেকাংশে দায়ী। কারণ, রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ময়লা ফেলার ডাস্টবিন দেওয়া হলেও নগরের বাসিন্দারা তা ব্যবহার না করে যত্রতত্র ময়লা ফেলেন। উচ্চশব্দে হুইসেল বাজিয়ে মোটরবাইক চালিয়ে এক প্রকার ত্রাস সৃষ্টি করেন পথচারীদের মধ্যে। অনেক ক্ষেত্রে ঘটে প্রাণহানিও। অনেক সময় দ্রুত চলাচলের ক্ষেত্রে ফুটপাথে মোটরসাইকেল তুলে দেন বাইকাররা। রাস্তা পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, যান চালানোর সময় মোবাইলে কথা বলা এসব রাজধানীতে চোখে পড়ে অহরহ। আর এসব কারণেও দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। ট্রাফিক আইন না মানা, ওভারটেকিং, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো ঢাকার যানজটসহ নানা দুর্ঘটনার কারণ। উল্টোপথে গাড়ি চলাচল যেমন বিঘ্নতার সৃষ্টি করে চলাচলে, একই সঙ্গে যানজট ও দুর্ঘটনার কারণ হয় এটি। নগরবাসীর সচেতনতাতেই এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করছেন নগরবিদরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন