পনেরো আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাজধানীর রাসেল স্কয়ারসংলগ্ন হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালসহ ধানমণ্ডি ও পান্থপথ এলাকার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলগুলোতে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নতুন বোর্ডার উঠানোর ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এসব এলাকার মেসগুলোতেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
পান্থপথ এলাকার হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে গত বছরের ১৪ আগস্ট ভয়াবাহ বোমা বিস্ফোরণে সাইফুল ইসলাম নামের এক ‘জঙ্গি’ নিহত হয়। সে সময় পুলিশ দাবি করেছিল, নিহত ‘জঙ্গি’ ১৫ আগস্ট শোক দিবসে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে আসা মিছিলগুলোতে আত্মঘাতী হামলা করে শত শত মানুষ মেরে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
তবে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আগের দিন রাতেই ‘জঙ্গির’ অবস্থান শনাক্ত করে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি)। সেই অভিযানের সময় হোটেলে অবস্থান করা ‘জঙ্গি’ বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত হয়। আর সেই ভয়াবহ বোমার আঘাতে ওই আবাসিক হোটেলের তৃতীয় তলার একটি কক্ষের দরজা, জানালা, ভবনের দেয়াল ভেঙে পড়ে। একই সঙ্গে ভবনের এক পাশের কিছু অংশ ধসে পড়ে মূল সড়কে।
ওই ঘটনার পর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেলগুলোতে নতুন বোর্ডার উঠানোর বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে বিশেষভাবে নির্দেশনা দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের ১৫ আগস্ট পালন উপলক্ষে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর, পান্থপথসহ আশপাশের আবাসিক হোটেল ও মেসগুলোতে নজরদারি বাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তবে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা ১৩ আগস্ট, সোমবার থেকে ১৫ আগস্ট, বুধবার পর্যন্ত তাদের হোটেলে নতুন কোনো বোর্ডার উঠাচ্ছেন না। বরং যারা আগে থেকেই সেই হোটেলে অবস্থান করছিলেন, তাদেরকে সোমবার থেকেই হোটেল ছেড়ে দিতে হয়েছে।
ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন সাজে হোটেল ওলিও
সরেজমিনে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে গিয়ে দেখা যায়, পুরো ভবনটির দেয়ালে নতুন করে রঙের কাজ করা হয়েছে। বোমার আঘাতে ভেঙে পড়া ভবনের সেই অংশটি এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া তৃতীয় তলার সেই কক্ষটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। সেই তৃতীয় তলাতেও এখন বোর্ডার ভাড়া দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ভেঙে পড়া সাইনবোর্ড সরিয়ে সেখানে আবারও নতুন করে একাধিক সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানোর জন্য হোটেলের মূলগেট থেকে ভেতর পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরাও বসানো হয়েছে।
ছবিঃ
হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনাল ছবি : প্রিয়.কম
হোটেলের প্রবেশ পথ দিয়ে দুই সিঁড়ি ওপরে ওঠার পরই চোখে পড়ল রিসিপশন। রিসিপশন ফাঁকা। চেয়ার, রিসিপশনের সামনের কক্ষগুলোও শূন্য। সুনসান নীরবতা। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তৃতীয় তলা থেকে নেমে এলেন হোটেল ম্যনেজার মোহাম্মদ তপু।
মোহাম্মদ তপু প্রিয়.কমকে বলেন, ‘হোটেলে আজ কোনো কক্ষ ভাড়া দেওয়া হবে না। শুধু আজ নয়, আগামী দুই দিন কোনো কক্ষ ভাড়া দেওয়া হবে না।’
কারণ জানতে চাইলে তপু বলেন, ‘গতবারের জঙ্গি নিহত হবার পর থেকেই পুলিশের অনেক ধরনের নির্দেশনা দেওয়া আছে। আর এবার তিন দিন হোটেলে কোনো বোর্ডার রাখা যাবে না বলেও জানিয়েছে পুলিশ।’
তিনি জানান, তার হোটেলে আটটি এসি রুম রয়েছে। প্রতিটি রুমের ভাড়া দুই হাজার টাকা। এ ছাড়াও বাকি নন এসি রুমগুলোর ভাড়া এক হাজার থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। তাই বোর্ডার না তুলতে পারায় তাদের কিছু আর্থিক ক্ষতি হবে। তবে নিরাপত্তার জন্য পুলিশের দেওয়া নির্দেশনা তারা মেনে নিয়েছেন।
বেড়েছে হোটেলের নিরাপত্তা
গতবছরে ‘জঙ্গি’ নিহতের ঘটনার পর থেকেই হোটেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের চেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে হোটেল ম্যানেজার তপু বলেন, ‘ নতুন কোনো বোর্ডার হোটেলে আসলে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা নেওয়া হয়। এ ছাড়াও পুরো হোটেলটি সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আর কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে তাকে হোটেলের কোনো কক্ষ ভাড়া দেওয়া হয় না।’
ছবিঃ হোটেল ওলিও
হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের ভেতরের দৃশ্য ছবি: প্রিয়.কম
তপু আরও বলেন, ‘গত বছরের হামলার ঘটনার সময় আমি এখানে ছিলাম না। অন্য আরেকজন দায়িত্বে ছিল। তবে এখন পুরো হোটেলের ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার ওপরেই। তাই পুলিশের নির্দেশ ও অন্যান্য নিয়মগুলো মেনে চলার চেষ্টা করি। যাতে আবার কোনো ঘটনা না ঘটে।’
মেসে মেসে পুলিশের অভিযান, হোটেলে সতর্কবার্তা
১৫ আগস্ট উপলক্ষে যাতে কোনো ধরনের নাশকতার ঘটনা না ঘটে, সে কারণে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। পান্থপথ ও ৩২ নম্বর এলাকা ও এর আশপাশের এলাকার মেসগুলোতে পুলিশ নিয়মিত তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন একাধিক এলাকবাসী।
শুক্রাবাদ এলাকার একটি মেসে থাকা এক যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘গতকাল সন্ধ্যার পর থেকেই গলির মধ্যে পুলিশের গাড়ি টহল দিয়েছে। আর রাত ৯টার দিকে আমাদের মেসে গিয়ে সবার নাম, পরিচয়, পেশা সব কিছু নোট করে নিয়েছে।’
পান্থপথ ও ধানমণ্ডির আবাসিক হোটেলগুলোতে পুলিশ সদস্যরা সতর্কবার্তা দিয়েছে বলেও জানিয়েছে একাধিক হোটেলের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। তবে সেসব হোটেলগুলোতে সরাসরি বোর্ডার তুলতে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি বলে জানায় তারা। যদিও সুনির্দিষ্টভাবে পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে কাউকে কক্ষ ভাড়া দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
নতুন কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে, প্রস্তুত পুলিশ
এই ব্যাপারে জানতে চাইলে ধানমণ্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ প্রিয়.কমকে বলেন, ‘১৫ আগস্ট উপলক্ষে আমার এলাকায় সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাই বাড়ানো হয়েছে। হোটেলগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে। আর আমার এলাকায় আবাসিক হোটেল আছে মাত্র দুইটা । একটা ২ নম্বর রোডে আম্বালা ইন ও স্টার কাবারের পেছনে হোটেল অ্যাম্ব্রুশিয়া। সেখানে শুধুমাত্র বিদেশিরা থাকে, আমাদের দেশের কেউ থাকে না। তবে তাদেরকেও সতর্ক করা হয়েছে।’
কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, তদন্ত) সমীর চন্দ্র সূত্রধর বলেন, ‘পান্থপথসহ পুরো এলাকাতে নিরাপত্তার জন্য পুলিশি যে কার্যক্রম সেটা চলছে। ওই এলাকার হোটেল-মেসগুলোতে সতর্কতামূলক অভিযান চলছে।’
হোটেল ওলিওতে বোর্ডার ওঠাতে নিষেধ করা হয়েছে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে রকম কিছু না, তবে বিশেষভাবে অনুমতিবিহীন যাতে কেউ না ওঠে এই ধরনের একটা সতর্ক বার্তা। নতুন করে যেন কোনো ঘটনা না হয়, সে জন্য এই অভিযান চলছে। আমাদের টহল পার্টির টহল জোরদার আছে।’
‘
‘অপারেশন অগাস্ট বাইট’
পান্থপথে স্কয়ার হাসপাতালের পাশে আবাসিক হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে গত বছরের ১৪ আগস্টে চালানো জঙ্গি অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন অগাস্ট বাইট’।
অভিযান শেষে তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল, ১৫ আগস্ট উপলক্ষে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে যে মিছিলগুলো আসবে, সেই মিছিল জঙ্গিরা আত্মঘাতী হামলা করবে, শত শত লোক মেরে ফেলবে। এমনি প্রস্তুতি ছিল জঙ্গিদের। মঙ্গলবার রাত থেকেই গোয়েন্দা সদস্যরা ওই জঙ্গির বিষয়ে নজরদারি করে আসছিল। সর্বশেষ হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে তার অবস্থান শনাক্ত করা হয়। তাকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু ওই জঙ্গি আত্মসমর্পণ না করে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে।’
সাবেক আইজিপি আরও বলেছিলেন, ‘নিহত জঙ্গির দেহে অনেক সুইসাইডাল ভেস্ট বাঁধা ছিল। বিস্ফোরণের ফলে তার অবস্থান করা কক্ষের দরজা-জানালা উড়ে গেছে। ভবনের এক পাশের কিছু অংশ ধসে পড়েছে। বোমার আঘাতে দরজা, জানালা, ভবনের দেয়াল ভেঙে পড়েছে, কাজেই কোনো জনসভার মধ্যে এই বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। কিন্তু গোয়েন্দাদের চৌকস নজরদারির কারণে তা সফল হয়নি।’
সেই দিন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম ‘অপারেশন অগাস্ট বাইট’ অভিযান শেষে বলেছিলেন, ‘হোটেল ওলিওতে জঙ্গির অবস্থান শনাক্ত করার পর মঙ্গলবার রাতে রুমে রুমে গিয়ে তল্লাশি করা হয়। তখন সব কক্ষের ভেতরে অবস্থানরত ব্যক্তিরা দরজা খুলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু চতুর্থ তলার ৩০১ নম্বর কক্ষের দরজায় নক (কড়াঘাত) করলে, দরজা না খুলে ভেতরে থেকে একজন বলেন, “সকাল হলে দরজা খুলব, তার আগে না।” এর পর ওই কক্ষের ভেতরে থাকা ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহ হয়। তখন কৌশলে বাইরে থেকে কক্ষটির দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় হোটেলের বাইরে থেকে কক্ষের জানালা দিয়ে ভেতরে কিছু বৈদ্যুতিক তার ঝোলানো দেখা যায়। তখনই নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ওই কক্ষেই জঙ্গি অবস্থান করছে।’
ওই অভিযানে বিস্ফোরণে নিহত জঙ্গি সাইফুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানায়। সাইফুল বরিশাল বিএম কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট চাকরির কথা বলে বাড়ি থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। ঢাকায় আসার পর সংগঠন থেকে শোক দিবসে আত্মঘাতী হামলার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয় বলে জনিয়েছিল পুলিশ।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন