খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে চলমান আন্দোলনের ইস্যু আড়াল করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশকে আগাম নির্বাচনমুখী করতে চাইছে বলে মনে করছে বিএনপি। দলের নেতারা বলেন, নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠাসহ অনেক ইস্যুর সমাধান করতে হবে। এর আগে নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আনার মধ্যে দুরভিসন্ধি আছে। তারা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের ইস্যু নিয়ে যখন দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ, তখন একে পাশ কাটাতে সরকার বিভিন্ন ইস্যু সামনে আনছে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করে তা আলোচনায় আনার চেষ্টা করছে।
সম্প্রতি, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চেয়ারম্যান করে আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ঘোষণা করেছে। এর পর বিএনপির সিনিয়র নেতারা বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে আলাপ-আলোচনা বিশ্লেষণ করেছেন। আমাদের সময়ের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি নেতারা বিষয়টি নিয়ে তাদের মত ব্যক্ত করেন।
বিএনপির নেতারা মনে করেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হতে হলে সবার আগে খালেদা জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। এর পর বিএনপি চেয়ারপারসনসহ দেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার বিষয়ে ঐকমত্য হতে হবে। তার পর জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা আসতে পারে।
বিএনপির মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার আন্দোলনকে আড়াল করতে চায়। জনগণের দৃষ্টি নির্বাচনমুখী করতে চায়। পাশাপাশি নানা কারণে সরকারের মধ্যে তৈরি হওয়া নার্ভাসনেস কাটিয়ে উঠতে চাইছে। এ লক্ষ্যে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল ও দেশের মানুষকে নির্বাচনমুখী করতে চাইছে। তাদের আলাপ-আলোচনা ও বিশ্লেষণে উল্লিখিত বিষয় উঠে এসেছে বলে জানান বিএনপি নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা মনে করেন, আওয়ামী লীগ মনে করে, দেশকে নির্বাচনমুখী করতে পারলে চলমান আন্দোলন নিয়ে বিএনপিতে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হবে। নির্বাচন নিয়ে নেতাদের মধ্যে বিদ্যমান ঐক্য বিভক্তি ও সন্দেহ দানা বাঁধবে। সে ক্ষেত্রে আন্দোলন রেখে দলের একটি অংশ নির্বাচনের দিকে ঝুঁকে পড়বে। ফলে বিএনপির চলমান আন্দোলন চরমভাবে ব্যাহত হবে। বিএনপি নেতাদের ভাষ্যমতে, বিষয়টি মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ঘোষণার পর বিএনপির সিনিয়র নেতারা অনানুষ্ঠানিক একাধিক বৈঠক করেছেন।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমাদের সময়কে বলেন, নির্বাচন হতে এখনো বেশ কয়েক মাস বাকি। এখনো সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ নেয়নি। দেশের জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়ে কোনো কথা তারা বলছে না। যদিও এসবই হচ্ছে দেশের মানুষের এখন মূল দাবি। কিন্তু হঠাৎ আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ঘোষণা করেছে। এর কারণ হচ্ছে, দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। তাই তাদের ক্ষমতায় থাকতে হলে নির্বাচনে নানা কারসাজি করতে হবে, সব কিছু ঠিকঠাক করতে হবে। এ জন্য আওয়ামী লীগের সময় বেশি তো লাগবেই। বিশেষ করে আমাদের আন্দোলনকে আড়াল করতেই এত আগেভাগে আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করেছে; কিন্তু কোনো লাভ হবে না।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকার সাজানো নীলনকশা নিয়ে এগোচ্ছে। ওই নীলনকশায় ২০১৪ সালে নির্বাচন না করার যে বিষয়, সেটা তাদেরই নীলনকশা। তারাই সেই অবস্থা তৈরি করেছে। আজকে সে অবস্থা ভয়াবহভাবে আছে। তা হলে কেন এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো আবার ওই জায়গায় (নির্দলীয় সরকার) এসে এক হচ্ছে নাÑ এটা অবশ্যই জনগণের সামনে বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। সব রাজনৈতিক দল ও সব গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে আহ্বান, আসুন আমরা একটা প্রশ্নে একমত হই। সেই প্রশ্নটি হচ্ছে একটা ইস্যুতে যে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচন চাই, গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার চাই, এ বিষয়ে একটা জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
সম্প্রতি এক বৈঠকে বিএনপির সিনিয়র এক নেতা আরেক নেতাকে প্রশ্ন করেনÑ নির্বাচনের সময় খালেদা জিয়া যদি জেলখানায় থাকেন, সরকারে যদি শেখ হাসিনা থাকে, তা হলে কি আমরা নির্বাচনে যাব? জবাবে গুরুত্বপূর্ণ ওই নেতা না-সূচক জবাব দেন। কূটনীতিকসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে দেখভাল করেন যিনি, ওই নেতার কাছে আরও জানতে চাওয়া হয়Ñ বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়, তা হলে কী হবে? জবাবে তিনি বলেন, দেশে নির্বাচন হবে না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন হলে দেশে-বিদেশে কেউ সমর্থন করবে না। বিশেষ করে সবাই এবার বিএনপিকে নির্বাচনে দেখতে চায়।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, নির্বাচন বলতে আমরা যা বুঝি, সেটা হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং ভোটাররা নির্বিঘেœ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোট পছন্দের ব্যক্তিকে দেবে। এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম একটা উপাদান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বিগত সময়ে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। আর হওয়ার কোনো নিশ্চয়তাও নেই। তাই আওয়ামী লীগ যদি মনে করে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করে দেশকে নির্বাচনমুখী করবে, তা হলে তারা ভুল চিন্তা করছে। কারণ খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে এবং শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। দেশের মানুষ আরেকবার হলেও খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আর কোনো নির্বাচন দেশে হবে না। আর খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে বিএনপিও নির্বাচনে যাবে না।
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আমাদের সময়কে বলেন, আওয়ামী লীগ যতই নির্বাচনী আমেজ তৈরির চেষ্টা করুক লাভ হবে না। কারণ দেশের মানুষ চায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক। সরকার যতই নীলনকশা করুক কাজ হবে না। আমাদেরও বক্তব্য স্পষ্টÑ নির্বাচন হতে হলে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। তার আগে দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন