শিশুবান্ধব শহর হতে হলে সড়কে শিশুদের নিরাপদে চলাচলের সুযোগ থাকতে হবে। দূষণমুক্ত পরিবেশের পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে পর্যাপ্ত সবুজ চত্বর, যেখানে শিশুরা বাধাহীনভাবে খেলতে পারবে। সুযোগ থাকতে হবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের। সর্বোপরি নিশ্চিত করতে হবে কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই সব ধরনের সেবাপ্রাপ্তি।
ঢাকার অবস্থান জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের শিশুবান্ধব শহরের এ সংজ্ঞার ঠিক বিপরীতে। এখানকার অধিকাংশ স্কুলেই খেলার মাঠ নেই। শিশুর চলাচলের উপযোগী নয় এ শহরের পথঘাট। পার্ক থাকলেও তা ক্ষমতাবানদের দখলে। অথবা পার্কে এমন কিছু তৈরি করা, যা শিশুদের খেলার উপযোগী নয়। শিশুদের জন্য নেই নিরাপদ গণপরিবহনও। এর ওপর রয়েছে সর্বব্যাপী দূষণ, যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ করছে।
এসব পীড়নের মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে রাজধানীর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কেজি ওয়ানের শিক্ষার্থী ছয় বছরের জারা। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তার স্কুল। চারতলা ভবনের স্কুলটিতে কোনো খেলার মাঠ নেই। খোলা জায়গা বা খেলার মাঠ নেই তাদের বাসার আশপাশেও। স্কুল থেকে ফিরে জারার সময় কাটে টেলিভিশনের পর্দায় কার্টুন দেখে অথবা মোবাইলে গেমস খেলে। এরই মধ্যে উচ্চতার তুলনায় ওজন বেড়েছে তার। চোখে উঠেছে মোটা লেন্সের চশমা।
শিশুস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শহরের শব্দ, বায়ু ও পানিদূষণ। বহুমাত্রিক এসব দূষণের কারণে কানে কম শোনা, ক্ষুধামান্দ্য, স্থায়ী মাথাব্যথা, নিদ্রাহীনতাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। এর মধ্যে শব্দ ও বায়ুদূষণ শিশুস্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। বাতাসে বিষাক্ত সিসা, কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করায় শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, ফুসফুসের সমস্যাসহ নানা সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
ঢাকা শহরের ছয়টি স্কুলে শিশুদের ফুসফুসের কার্যকারিতা নিয়ে গত বছর একটি গবেষণা চালায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির আরবান ল্যাব। ফলাফলে দেখা যায়, ওই স্কুলগুলোর ২৫ শতাংশ শিশুর ফুসফুস পূর্ণমাত্রায় কাজ করছে না। তাদের ফুসফুস ৬৫ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ করছে।
গবেষণা দলের সদস্য ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাবিব। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার ছয়টি স্কুলের চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সী শিশুদের ফুসফুসের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, ২৫ শতাংশ শিশুর ফুসফুসের কার্যকারিতা শতভাগ নেই। কারো ফুসফুসের কার্যকারিতা ৬৫, কারো ৭০ শতাংশ। অর্থাত্ এ শহরের শিশুরা তাদের ফুসফুসের পূর্ণ কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে। মূলত বায়ুদূষণের কারণে শিশুরা ফুসফুসের কার্যকারিতা হারাচ্ছে।
বায়ুদূষণের কারণে এ শহরের শিশুদের বড় অংশের শ্বাসজনিত সমস্যা রয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, এখানে জন্ম নেয়া শিশুদের প্রথম সমস্যা হলো— শ্বাস-প্রশ্বাসে অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট ও কাশিজাতীয় সমস্যা। এছাড়া প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে বসবাস করতে করতে শিশুর শ্রবণশক্তি কমে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, যে পরিমাণ স্বাভাবিক আলোয় একজন মানুষের বেড়ে ওঠা প্রয়োজন, তাও তারা পাচ্ছে না।
রাজধানীতে উঁচু উঁচু ভবনের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে খোলা জায়গা। ধ্বংস করা হচ্ছে খেলার মাঠও। মাটির স্পর্শ ছাড়াই বড় হচ্ছে নগরীর শিশুরা। ব্যাহত হচ্ছে শিশুর সামাজিকীকরণ। একাকিত্ব ঘোচাতে তারা সময় কাটাচ্ছে টেলিভিশনের পর্দায়। ভিডিও গেমস খেলেও দিনের বড় অংশ কাটিয়ে দিচ্ছে তারা। এতে মুটিয়ে যাচ্ছে শহরের শিশুরা। দি আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে প্রকাশিত ভিডিও গেম-সংক্রান্ত এক গবেষণায় দেখা গেছে, শারীরিক পরিশ্রম না করে ভিডিও গেমস খেলা শিশুদের শরীরে দৈনিক অতিরিক্ত ১৬৩ কিলোক্যালরি খাবার উদ্বৃত্ত থাকে। ওই শিশুদের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার হারও তাই বেশি।
ঢাকা শহর শিশুবান্ধব নয় বলে স্বীকার করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) খান মোহাম্মদ বিলাল। তিনি বলেন, ঢাকা শহর সত্যিই শিশুদের জন্য উপযোগী নয়। তবে এ অবস্থার উন্নয়নে ঢাকা শহরের ৩২টির মতো খেলার মাঠ ও পার্ক ব্যবহার উপযোগী করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এসব মাঠ ও পার্ক যাতে বেদখল না হয়, সে ব্যাপারে নজরদারি অব্যাহত রাখা হবে।
শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক পীড়নও সইতে হচ্ছে এ শহরের শিশুদের। শিক্ষা পদ্ধতিকেও এজন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, লেখাপড়ার নামে শিশুদের এক ধরনের মানসিক পীড়নের মধ্যে ফেলে দেয়া হচ্ছে। অধিকাংশ অভিভাবক শিশুকে একাধারে ভালো ছাত্র, খেলোয়াড়, গায়ক, নাচিয়ে, আঁকিয়ে বানানোর চেষ্টা করেন। এসবের গোলকধাঁধায় পড়ে শিশু তার শৈশবই হারিয়ে ফেলছে। এত এত বই-খাতার ভারে শিশুদের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুনতাসীর মারুফ এ প্রসঙ্গে বলেন, এখনকার শিশুরা অ্যাপার্টমেন্টভিত্তিক বাসায় বড় হচ্ছে। বাইরে বড় মাঠে খেলার সুযোগ নেই, প্রকৃতির কাছে যাচ্ছে না তারা। সে কারণে তাদের সামাজিক ও মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। তাদের সামাজিকীকরণ ব্যাহত হচ্ছে। তাই বিকল্প হিসেবে মোবাইল, ট্যাব ব্যবহার করছে। এছাড়া সামাজিকীকরণের শিক্ষাটা কম হওয়ায় পরবর্তী জীবনে কখনো সমস্যায় পড়লে তা কাটিয়ে ওঠা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। যেকোনো মানসিক চাপে তারা সহজে ভেঙে পড়ে। বড় হওয়ার পর ডিপ্রেশন, অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডার, সোস্যাল ফোবিয়াসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
ঢাকা শহরকে শিশুবান্ধব করতে শিশুদের মতামত নিয়ে তাদের উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই বলে মনে করেন বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি ডিরেক্টর রিফাত বিন সাত্তার। তিনি বলেন, নীতিনির্ধারকরা যখন শিশুদের জন্য কোনো পরিকল্পনা করবেন, তখন তাদেরও মতামত নিতে হবে। শিশুদের কী প্রয়োজন, কোথায় ঘাটতি আছে, তা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত পার্ক, খেলার জন্য যেসব সরঞ্জাম দরকার তা যেন থাকে, গুরুত্ব দিতে হবে সেদিকেও।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন