পর্তুগালের শেষ আট নিশ্চিত করার ম্যাচে একাদশে সুযোগ মেলেনি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। দীর্ঘ ১৮ বছরের জাতীয় দলের ক্যারিয়ারে এই প্রথম তাকে বেঞ্চে রেখে একাদশ সাজান কোচ ফার্নান্দো সান্তোস। সিআর সেভেনের যায়গায় সুযোগ পেয়েই হ্যাটট্রিক করে নায়ক ‘অখ্যাত’ গঞ্জালো রামোস। তার হ্যাটট্রিকেই সুইজারল্যাল্ডকে ৬-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে ২০০৬ বিশ্বকাপের পর কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলো পর্তুগাল। বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে পর্তুগালের বড় জয় আছে শুধু জার্মানির। ২০১৪’র সেমিতে ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে হারিয়েছিল তারা। জাতীয় দলে চতুর্থ ম্যাচেই কাতার বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক করলেন ২১ বছরের তরুণ গঞ্জালো রামোস। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটি পর্তুগালের তৃতীয় হ্যাটট্রিক, নকআউট পর্বে দ্বিতীয়। এর আগে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ২০১৮ বিশ্বকাপে এবং ইউসেবিও ১৯৬৬ বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। কাল লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে রামোসের সঙ্গে গোল উৎসবে যোগ দেন পেপে, রাফায়েল গেরেইরো ও রাফায়েল লেয়াও।
সুইজারল্যান্ডের হয়ে ব্যবধান কমান ম্যানুয়েল আকানজি। ৬-১ গোলের এই জয়ে আগামী ১০ই ডিসেম্বর আল থুমামা স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের প্রতিপক্ষ মরক্কো।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে বেঞ্চে রেখে পর্তুগাল শেষবার ম্যাচ খেলেছিল ২০০৪ ইউরোতে রাশিয়ার বিপক্ষে। সে ম্যাচে রাশিয়াকে হারিয়েছিল পর্তুগাল। কালও ঘটলো একই ঘটনা। তাকে ছাড়া খেলতে নেমেই সুইজারল্যান্ডকে সহজেই হারালো তারা। অথচ বিশ্বকাপের শুরু থেকেই পর্তুগিজ কোচের পছন্দের তালিকায় ছিলেন রোনালদো। গ্রুপ পর্বের তিনটি ম্যাচেই তাকে একাদশে রেখে দল সাজান সান্তোস। আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে তিনি দলে রোনালদোর অপরিহার্যতা নিয়েও অনেকবার কথা বলেছেন। এমনকি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে যখন দ্বন্দ্ব চলছিল, তখনো রোনালদোর পাশে ছিলেন সান্তোস। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচের পর থেকেই পরিস্থিতি কিছুটা বদলে যায়। সেদিন ৬৫তম মিনিটে রোনালদোকে তুলে নেন সান্তোস। যা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি ‘সিআর সেভেন’। মাঠ ছাড়ার সময় দক্ষিণ কোরিয়ার এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে যান রোনালদো। দ্রুত মাঠ ছেড়ে যেতে বলার কারণেই মূলত কোরিয়ান খেলোয়াড়ের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখান পর্তুগিজ তারকা। দক্ষিণ কোরিয়ার খেলোয়াড়ের সঙ্গে রাগারাগি করেই থামেননি। পরবর্তীতে কোচ ফার্নান্দো সান্তোসের উদ্দেশ্যেও তির্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দেন তিনি। যার ফল হিসেবেই হয়তো গতকাল বেঞ্চে থকে শুরু করতে হয়েছে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলদাতাকে। সান্তোস রোনালদোর যায়গায় যাকে খেলিয়েছেন, সেই গঞ্জালো রামোস তাকে হতাশ করেননি। প্রথমবারের মতো একাদশে সুযোগ পেয়েই হ্যাটট্রিক করেছেন। বিশ্বকাপের আগের তিন ম্যাচে দুটিতে বদলি হিসেবে নেমে মাত্র ১০ মিনিট খেলার সুযোগ পাওয়া রামোস কাল গোলের শুরু করেন ম্যাচের ১৭তম মিনিটে। বেনফিকার ২১ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড গোলটাও করেছেন দুর্দান্ত। বাঁ দিক থেকে জোয়াও ফেলিক্সের বাড়ানো বল ধরে সঙ্গে লেগে থাকা প্রতিপক্ষের চ্যালেঞ্জ সামলে দুরূহ কোণ থেকে নেন বুলেট গতির শট, কাছের পোস্ট ঘেঁষে বল খুঁজে নেয় ঠিকানা। গোলরক্ষক ইয়ান সমারের যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ৩০তম মিনিটে অন্যপাশে হতে পারতো আরেকটি চমৎকার গোল। অনেক দূর থেকে জেরদান শাকিরির দুর্দান্ত ফ্রি কিকে বল রক্ষণ দেয়ালের ওপর দিয়ে বাঁক খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া দিয়েগো কস্তার আঙুল ছুঁয়ে যায় বাইরে।
এর তিন মিনিট পরই ব্যবধান দ্বিগুণ করে পর্তুগাল। ব্রুনো ফার্নান্দেজের কর্নারে লাফিয়ে উঠে নেওয়া হেডে গোলটি করেন পেপে। এই গোলের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি বয়সী ফুটবলার হিসেবে (৩৯ বছর) বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে গোল করলেন পেপে। ৪৩তম মিনিটে ব্যবধান বাড়তে পারতো আরও। দারুণ এক প্রতি-আক্রমণে ডিফেন্ডারদের পেছনে ফেলে বক্সে ঢুকে ওয়ান-টু-ওয়ানে শট নেন রামোস। ঝাঁপিয়ে কর্নারের বিনিময়ে ঠেকান গোলরক্ষক সমের। ৫১তম মিনিটে ম্যাচ শেষ করে দেন রামোস। দিয়োগো দালতের বাড়ানোর বলে ঠান্ডা মাথায় গোলটি করেন পর্তুগালের হয়ে চতুর্থ ম্যাচে মাঠে নামা এই ফরোয়ার্ড। ব্যবধান ৪-০ করেছেন ডিফেন্ডার রাফায়েল গেরেইরো। ম্যাচের ৫৮ মিনিটে কর্নার থেকে সুইজারল্যান্ডের ব্যবধান কমান ম্যানুয়েল আকানজি (১-৪। ৬৬ মিনিটে হ্যাটট্রিক পূরণ করেন গঞ্জালো রামোস (৫-১)। এবারের বিশ্বকাপে এটি প্রথম হ্যাটট্রিক। যা তাকে স্থান দিয়েছে রেকর্ডবুকে। যে রেকর্ড আছেন শুধু জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসা। ২০০২ সালে ক্লোসার পর গঞ্জালো রামোস দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপে পূর্ণ অভিষেকে হ্যাটট্রিক করলেন। পর্তুগালের হয়ে নকআউট পর্বে দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক। এর আগে ১৯৬৬ সালে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে চার গোল করেছিলেন গ্রেট ইউসেবিও। এছাড়া রাশিয়া বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে স্পেনের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন রোনালদো। ৭২তম মিনিটে ‘হ্যাটট্রিক ম্যান’ গঞ্জালো রামোসোর জায়গায় মাঠে নামেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। বদলি নামা এই বিশ্বতারকা গোলও করেছিলেন। যদিও অফসাইডের কারণে সে গোল বাতিল করে দেন রেফারি সিজার আরতরো রামোস। যোগকরা সময়ে সুইজারল্যান্ডের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন এসি মিলান তারকা রাফায়েল লেয়াও (৬-১)। নকআউট পর্বে ৬-১ গোলের জয় নিয়ে আগামী ১০ই ডিসেম্বর মরক্কোর মুখোমুখি হবে পর্তুগাল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন