বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য কিছু তারিখ আছে যা সবসময় বিরাট গর্বের হয়ে ফিরে আসে। মনে করিয়ে দিয়ে যায় বাংলার দামাল ছেলেদের কীর্তির কথা। তেমনই একটা দিন ৩১ মে। ১৯৯৯ সালের এই দিনে ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বিশ্ব শুনেছিল বাঘের গর্জন। প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া পুঁচকে বাংলাদেশ সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়ে কাঁপিয়ে দেয় দুনিয়া।
সে এক অন্যরকম দিন ছিল। সেই প্রথম এমন বড় মঞ্চে খেলা এবং সেখানে বিরাট ‘অঘটন’ ঘটিয়ে দেওয়া। যা যে কারও জন্য ছিল কল্পনার বাইরে। ওটা ছিল ’৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচ। একমাত্র স্কটল্যান্ড বাদে সব দলের কাছে হেরেছিল বাংলাদেশ।
পাকিস্তানের ‘টু ডাব্লিউ’ জুটি ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুস ছিলেন। আকরাম আবার অধিনায়ক। তরুণ শোয়েব আখতার তখন আগুনের গোলা ছোড়েন। কিন্তু তাকে ওই ম্যাচে একটাও উইকেট দেয়নি বাংলাদেশ।
টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে ৯ উইকেটে ২২৩ রান তুলেছিল বাংলাদেশ। জবাবে ১৬১ রানেই অল আউট ’৯২-এর চ্যাম্পিয়নরা। ৬২ রানের এক অবিশ্বাস্য জয়। ব্যাট হাতে ২৭ রান করার পর ১০ ওভারে ৩১ রানে ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন।
অবিস্মরণীয় জয় নিশ্চিত হতেই মাঠে ঢুকে পড়েন অনেক প্রবাসী। উল্লাস করতে করতে খেলোয়াড়দের কাছে ছুটছিলেন। উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান খালেদ মাসুদ পাইলট এসব দেখে ঊর্ধশ্বাসে ছুটছিলেন ড্রেসিং রুমের দিকে। ‘কখন যে ছোঁ মেরে কে আমার ক্যাপটা কেড়ে নিয়েছে তা বুঝতে পারিনি।’ পাইলট হাসেন। আর সুখস্মৃতিতে ডোবেন।
২২৪ রান তাড়ায় ৪২ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর পাকিস্তানের অধিনায়ক আকরাম লড়েছিলেন। ২৯ রান করে সপ্তম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়েছিলেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর বলে। আকরামের মতো কিংবদন্তির বিপক্ষে বল করাই কঠিন। কিন্তু স্মৃতি হাতড়ে খালেদ মাহমুদ জানান, ‘ওয়াসিম আকরাম আমার এক ওভার মোকাবিলা করেছিলেন। ওই ওভারে ড্রাইভ মেরে চারও মেরেছিলেন আমাকে। আমি তখন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।’
ওয়াসিম আকরামের জন্য এমন রাঙা চোখ দেখা ছিল বিস্ময়ের। তাও বাংলাদেশের এক ছোটখাটো গড়নের মিডিয়াম পেসারের। বাংলাদেশকে প্রথম বিশ্বকাপে তোলায় নেতৃত্ব দেওয়া আকরাম খানের সঙ্গে সখ্য ছিল পাকিস্তানি গ্রেটের। খালেদ মাহমুদের বিরুদ্ধে নালিশও করেছিলেন! সাবেক এই অলরাউন্ডারের সেই নালিশের ঘটনা মনে করে বলেন, ওয়াসিম বলেছিলেন, “আকরাম, ছোটু আমার দিকে তাকিয়ে আছে।’’
পাকিস্তানের সবার মতো ওই ম্যাচে ওয়াসিম আকরামও বিরাট ধাক্কা খেয়েছিলেন। বিশ্বকাপের অন্যতম শক্তিশালী দল ছিল তাদের। তবে এখনো আকরাম নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করেন, ‘ক্রিকেট বোধের দিক থেকে বললে সেই ম্যাচে বাংলাদেশ সেরা দল হিসেবেই জিতেছিল। তারা ভালো বল করেছিল। আসলে সবদিক থেকে আমাদের চেয়ে ভালো খেলেছিল তারা।’
পরের বছর বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পায়। ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের যাত্রা নতুন পথ খুঁজে পায়। আর দিনে দিনে বাংলাদেশ তো হয়ে উঠেছে জায়ান্ট কিলার। ২০১৫ সালে পাকিস্তানকে ওয়ানডে সিরিজেও হারায় বাংলাদেশ। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে যে কোনো দলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ভয়ংকর।
কিন্তু ১৯৯৯ এর ওই ম্যাচ বাংলাদেশের ক্রিকেটের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া। বাংলাদেশও যে পারবে তার এক সিলমোহর ছিল পাকিস্তানকে হারানোর ম্যাচটি। ১৯৯৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে খেলা বাংলাদেশকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।
কিন্তু এখনো ওই ম্যাচের কথা মনে করলে দেশের ক্রিকেটের ভিত গড়াদের অন্যতম আকরাম খান কষ্ট পান। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান গ্রেট ব্যাটসম্যান গর্ডন গ্রিনিজ সেই আইসিসি ট্রফির আগ থেকে বাংলাদেশকে বিশ্ব মঞ্চে তুলে নিতে কোচ হিসেবে অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানকে হারিয়ে বিশ্ব কাঁপানোর দিনটাতেই নর্দাম্পটন থেকে তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল বড় বেশি অপমানিত হয়ে। অথচ বাংলাদেশের ক্রিকেট অন্তপ্রাণ হয়ে উঠে এই দেশের নাগরিকত্বও অর্জন করেছিলেন ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি।
‘পাকিস্তানের সঙ্গে ম্যাচের দিন ওর সঙ্গে চুক্তির শেষ দিন ছিল। সেদিন দুপুরে ও বরখাস্ত হয়।’ বোর্ডের কিছু কর্মকর্তা গ্রিনিজকে পছন্দ করতেন না। আকরাম ব্যাটিং থেকে ড্রেসিং রুমে ফিরে দেখেন গ্রিনিজ সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন। ‘তার অবদান কোনোদিন বাংলাদেশ ভুলতে পারবে না। মানসিক এবং শারীরিক দিক দিয়ে আমাদের অনেক সমর্থন করেছেন।’ আকরামের দীর্ঘশ্বাস ভারী হয়, ‘যে বাংলাদেশের জন্য এতকিছু করেছে তাকে এভাবে বিদায় দেওয়াটা মানতে পারি না। আমার কাছে এখনো খারাপ লাগে।’
১৯৯৯ এর ৩১ মে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য যে দিনটি অসম্ভব গর্বের সেই দিনটাতেই জড়িয়ে আছে কিছুটা কলঙ্কও।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন