বাংলাদেশের ক্রিকেট সেবার নারী ক্রিকেটারদের ৬০০ টাকার ম্যাচ ফি কেলেঙ্কারি নিয়ে উত্তাল। তারপর বলা হলো, এক হাজার টাকা করা হবে। এ নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে রুমানা আহমেদ ঠিক ‘আরাম’ করে কথা বলতে পারছিলেন না। আশপাশে আত্মীয়-স্বজনরা ছিলেন। তাই টাকার অঙ্কটা মুখ ফুটে বলছিলেন না। এরপর তো কত জল গড়িয়েছে। নারী ক্রিকেটারদের বেতনও বেড়েছে। কিন্তু সেগুলো যেচে পড়ে দেওয়া হয়নি, অর্জন করতে হয়েছে।
দীর্ঘদিন কোনো ম্যাচ পায়নি বাংলাদেশ। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে সব ম্যাচে হার। রা পড়ে গিয়েছিল সবদিকে। কী ভাগ্য! পরের তিন সিরিজের সবকটিতেই জয়। এশিয়া কাপের শিরোপা, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়, তারপর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। ভাগ্য বোধ হয় এভাবেও দিতে পারে।
রুমানা আহমেদ সেসব দিনের কথা ভুলতে চান। যে সাফল্য তাদের জীবন বদলে দিয়েছে, সেগুলোকেই আপাতত আঁকড়ে ধরতে চান। শেষ ১৪ ম্যাচে ২১ উইকেট নিয়ে লেগ স্পিনে কুপোকাত করেছেন, ঘুরিয়ে দিয়েছেন নিজের ভাগ্যের চাকাকেও।
কত অবহেলা, কত কটু কথা শুনতে হয়েছে চারিদিকে, তার হিসাব নেই। লেবুও অনেক কচলানো হয়েছে। এরপরও হয়েছে নতুন সূর্যোদয়। এবার তাতেই একটু পিঠ রাখা যাক। দেশে ফিরে প্রিয়.কমের মুখোমুখি হয়ে রুমানা আহমেদের ভাবনা সে রকমই।
প্রিয়.কম: পরপর তিনটি শিরোপা জিতলেন, কেমন লাগছে?
রুমানা: খুব বেশিই ভালো লাগছে (হাসি)। কখনো ভাবিইনি। নিজে ও দলের মধ্যে অনেক আত্মবিশ্বাস পাচ্ছি। এমন অর্জন আমাদের জন্য অনেক বড় ব্যাপার।
প্রিয়.কম: ১৪ ম্যাচে ২১ উইকেট, দলের মধ্যে সর্বোচ্চ। শুরু থেকে আলাদা কোনো পরিকল্পনা ছিল?
রুমানা: না, ওভাবে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ব্যাটিংটা সবসময় ভালো করলেও এবার সেখানে সুবিধা করতে পারিনি। তাই মন খারাপ। সেদিক থেকে বলতে গেলে, হাতে অপশন ছিল কেবল বোলিংটা। সেটাই চেষ্টা করেছি, সফল হয়েছি। কঠিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষেও ভাল করেছি। সব মিলিয়ে বলব, একদিক দিয়ে স্যাটিসফাইড।
প্রিয়.কম: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পরিকল্পনা? বাছাই পর্বে চ্যাম্পিয়ন হবেন ভেবেছিলেন?
রুমানা: অবশ্যই সেমিফাইনাল পর্যন্ত অন্ততপক্ষে যেতে চাইব। তা ছাড়া আমরা যখন ২০১৬ সালে থাইল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি বাছাইপর্ব খেলেছি, তখন শেষ বলে গিয়ে হেরেছি। তাই সেই ব্যাপারটা এবার আমাদের মনে কাজ করেছিল। যেভাবেই হোক, আমরা চেয়েছিলাম জায়গা করে নিতে। শিরোপা জিতব, সেটা ভাবিনি। তবে আমাদের সামর্থ্য নিয়ে আমরা আশাবাদী ছিলাম। তাই চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় অবাক হইনি।
প্রিয়.কম: আপনার শুরুর পথচলা সহজ ছিল না। অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। বিশেষ করে পড়াশোনার সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে। এখন কি মনে হয় আপনি সফল?
রুমানা: সত্যি বলতে, সেটা মনে হয় না। আমি নিজেকে আরও ছাড়িয়ে যেতে চাই। আরও ভালো করতে চাই। কিন্তু টানা সিরিজের আগে এই ভাবনাটা ছিল না আমার মধ্যে। আমি খেলা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। কারণ টানা আমাদের কোনো খেলা ছিল না। কেউ যেন কোনো গুরুত্বই দিচ্ছিল না। ইচ্ছে করে অনুশীলনেও যেতাম না মাঝে মাঝে। ভাবতাম, খেলা নেই তাহলে আর কী হবে। একপর্যায়ে ভেবেছিলাম, অন্য কাজ করব। তারপর তো খেলা শুরু হলো। এখন টানা খেলা আমাদের। এখন আমি সন্তুষ্ট।
প্রিয়.কম: সমর্থকদের কাছ থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
রুমানা: বলতে কষ্ট হলেও বলব, এখন যেমন পাচ্ছি, আগে সেটা ছিল না। আমরা দেশের জন্য খেলি। টানা সিরিজের আগে যখন এই ঢাকার রাস্তাতেই বের হতাম, তখন রাস্তায় হাঁটলেও অনেক কথা শুনতে হতো। নারী ক্রিকেট দলের সদস্য শুনলে বলত, ছেলেরাই কিছু করতে পারছে না, এরা আবার কী করবে! এদের দিয়ে কিছুই হবে না। আর ফেসবুকে ঢুকলে তো দেখতেই পাই, কতজন, কীভাবে বাজে কথা বলে। কিন্তু এমন না যে, আমরা চেষ্টা করছি না।
প্রিয়.কম: আর প্রতিপক্ষের মানসিকতা? সেটা বদলেছে?
রুমানা: হ্যাঁ, সে তো বদলেছেই। এখন সবার মুখে মুখেই বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের কথা। এশিয়া কাপের সময় একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে সবার মুখে মুখে বাংলাদেশের কথা। সবাই অনেক প্রশংসা করেছে আমাদের। তারা বলেছে, স্বীকার করেছে যে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল এখন অনেক উন্নতি করছে।
প্রিয়.কম: সফলতা পাচ্ছেন, আপনারাও খুশি। কিন্তু বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা ফিটনেস নিয়ে কতটা সচেতন?
রুমানা: সত্যি বলতে এই জায়গায় আমাদের অনেক ঘাটতি আছে। আমাদের অবহেলা আছে, জ্ঞানের অভাব আছে। আমি আমার কথাই বলি, এখন আমার যা ফিটনেস তার চেয়েও ডাবল হওয়া উচিত ছিল। তারপরও আমরা নিজেদের মধ্যে এগুলো নিয়ে আলাপ করি, চেষ্টা করি।
আর বাইরের দলগুলোর কথা যদি বলেন বিশেষ করে, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড; এরা জন্ম থেকেই আলাদাভাবে বেড়ে ওঠে। আমাদের আবহাওয়ার কারণে সেভাবে হয় না। তারপরও ধরুণ খাদ্যাভাস। এটাও অনেক বড় ব্যাপার। একে তো আমাদের এগুলো মেনে খাওয়ার জন্য অনেকের সেই অর্থও নেই। আবার যা-ও বা আছে, যা চাই সেইসব খাবার হাতের নাগালেও নেই। অর্থাৎ, দুদিক থেকেই আমাদের সমস্যা আছে।
জিমনেসিয়ামও একটা গুরুত্ব পাওয়ার মতো ব্যাপার। আমরা মেয়েরা চাইলেই সবখানে রানিং অনুশীলন করতে পারি না, জিমেও অনুশীলন করতে পারি না। তো আমাদের যদি আলাদা মাঠ, জিমনেসিয়ামের সুযোগ থাকল, তাহলে অনেক ভালো হতো আমাদের জন্য।
প্রিয়.কম: বড় দলগুলো চারদিনের ম্যাচ, টেস্ট খেলছে। আপনাদের এ নিয়ে পরিকল্পনা?
রুমানা: আমাদেরও পরিকল্পনা আছে। আমরাও এগুলো নিয়ে ভাবছি। অবশ্যই লঙ্গার ভার্সনের ক্রিকেটই তো আসল। আমরাও স্বপ্ন দেখি সাদা পোশাকে ক্রিকেট খেলার। যদি আমরা এটা করতে পারতাম, সঙ্গে বাইরে থেকে দলগুলোতে দুয়েকজন বিদেশি ক্রিকেটার আনতে পারতাম, তাহলে অনেক ভালো হতো। আমরা স্যারদের (কোচ) সাথেও আলাপ করেছি। তারা আমাদের বলেছে, তোমরা যেহেতু এখন ভালো করছো, সেটা ধরে রাখো। তাহলে লঙ্গার ভার্সনের সুযোগও আসবে সামনে।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন