তিন শব্দের একটি নাম সাকিব আল হাসান। বিশ্বক্রিকেটের হাজারো কীর্তি আর কীর্তিমানের ভীড়ে হীরকখণ্ডের মতো চকচক করে এক বাংলাদেশির কৃতিত্ব। যা রূপকথার চেয়ে কম কোথায়?
ষোলকোটি মানুষের একটা দেশের প্রিয় খেলাটার আশা আকাঙ্খা স্বপ্ন সবকিছু মিশে থাকে এই যুবকের নামের সাথে! প্রত্যাশার হিমালয়সম বোঝা মাথায় নিয়ে নিরন্তর যিনি মাঠের সবুজের বুকে নিজেকে প্রমাণ করে চলেছেন, বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের ছোট্ট তালিকায় আজ সসম্মানে উচ্চারিত হয় তাঁর নামটা।
বামহাতি এই ছেলেটার জন্মই হয়েছে যেন রেকর্ড ভাঙাগড়ার খেলায় মেতে ওঠার জন্যে। রেকর্ড নিয়ে ছিনিমিনি খেলাই যার স্বভাব আজ শুনবো তার উঠে আসার গল্প।
ঠিক একত্রিশ বছর আগে, মাগুরায় বসন্তের বাতাস গায়ে মেখে পৃথিবীর আলোয় এসেছিলেন ফয়সাল নামের ছেলেটা; আজ যিনি আমাদের সাকিব আল হাসান। ১৯৮৭ সালের ২৪ মার্চ মাগুরা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
বাবা মাশরুর রেজার ফুটবলের খুব শখ ছিল ছোটকালে। তৃতীয় বিভাগে কিছুদিন খেলেছিলেনও। কিন্ত জীবিকার তাগিদে জীবন নদীর গতিপথটা পাল্টে হয়ে গেলেন পুরোদস্তুর ব্যাংক কর্মকর্তা। প্রথম সন্তান ফয়সালের যখন জন্ম হলো, ঠিক করেছিলেন ছেলেকে ফুটবলার বানাবেন, নিজের দেখা অপূর্ণ স্বপ্নগুলো পূরণ হবে ফয়সালের চোখে।
কিন্ত ভাগ্যদেবতার ইচ্ছেটা ছিলো অন্যরকম। ফয়সালের বেড়ে ওঠার সময়টায় এই বঙ্গে ক্রিকেট ডালপালা মেলছে, কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি জয়, মালয়েশিয়ায় আকরাম-নান্নু-মিনহাজদের পাগলাটে দৌড় ফয়সাল দেখেছিলেন কিনা কে জানে! তারপর তো ১৯৯৯ বিশ্বকাপে নর্দাম্পটনে রূপকথার পাকিস্তানবধ! ফুটবল ছেড়ে বছর বারো’র ছেলেটা প্রেমে পড়লো ক্রিকেটের।
বরাবরই দারুণ সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী সাকিব যেন পেলে-ম্যারাডোনা হতে চাইলেন না, চাইলেন বাংলাদেশের জার্সি গায়ে বিশ্ব মাতাতে। তাই ফুটবলপাগল বাবা মাশরুর রেজা যখন তাঁকে বললেন ক্রিকেট ছেড়ে ফুটবলে মনোযোগ দিতে, সাকিব পরিষ্কার করে বলে দিলেন, “ক্রিকেট খেললে বিশ্বকাপ খেলা যাবে।”
ফুফাতো ভাই মেহেদী হাসান উজ্জ্বল ফুটবলার ছিলেন, বাবাও ছিলেন ফুটবলপ্রেমী। ফলে বাড়িতে খেলাধুলার অনুকূল পরিবেশ ছিলো বরাবরই। তবে প্রথমদিকে বাবা সেভাবে তাঁর খেলাধুলায় সেভাবে উৎসাহ দিতে চাননি, ভয় ছিলো পড়াশুনায় বরাবরই দারুণ ফয়সাল শেষমেষ না আবার খেলাধুলা করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে! সৌভাগ্যবশত, সাকিব পাশে পেয়েছিলেন মা শিরিন আখতারকে। আর পেয়েছিলেন একজন সাদ্দাম হোসেন গোর্কিকে। তিনিই প্রথম সাকিবকে আবিষ্কার করেন, এরপর তাঁকে ক্রিকেটে নিয়মিত এবং মনোযোগী করে তোলেন। সেখানেই শেষ নয়। শুরুতে সাকিব পেস বোলিং করতেন, গোর্কিই তাঁকে প্রথম স্পিন বোলিং করে দেখতে বলেন। আর এরপর সাকিব নিজ হাতে গড়েছেন ইতিহাস, মাগুরার দস্যি ছেলে ‘ফয়সাল’ থেকে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন সাকিব আল হাসান।
সাভারের বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংক্ষেপে বিকেএসপি; বাংলাদেশের খেলাধুলা শিক্ষার আঁতুড়ঘর। এখানেই শুরু মাগুরার এক অখ্যাত কিশোরের বিশ্বসেরা হয়ে ওঠার মিশনের।
মাত্র পনেরো বছর বয়েস তখন, ডাক পেলেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। ২০০৫-এ তিনজাতি সিরিজের ফাইনালে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঝোড়ো সেঞ্চুরির পাশাপাশি নিলেন তিন উইকেট, হলেন ম্যাচসেরা।
বয়সভিত্তিক দলে পারফরম্যান্স নজরকাড়া, ছিলেন জাতীয় দলের রাডারেই। মোহাম্মদ রফিককে সঙ্গ দেয়ার মতো বাঁহাতি স্পিনারের খোঁজে তখন হন্যে হয়ে ঘুরছেন নির্বাচকেরা। প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ একটা জুয়া খেললেন ২০০৬-এ; মুশফিক-ফরহাদ রেজার সাথে সাকিব; তিন নবাগতকে পাঠিয়ে দিলেন জিম্বাবুয়ে সফরে। আগেই সিরিজ হার নিশ্চিত হয়ে যাওয়া ম্যাচে শাহরিয়ার নাফীসের সেঞ্চুরীতে আট উইকেটে জয়; সেদিন সাকিবকে হয়তো আলাদাভাবে নজর দিয়ে দেখেননি কেউই। ব্যাটিংয়ে ত্রিশ রানের পাশে হাত ঘুরিয়ে আউট করেছিলেন এলটন চিগাম্বুরাকে।
এরপর ক্যারিবিয়ান সাগরপাড়ে ২০০৭ বিশ্বকাপের মঞ্চ, অচেনা মাঠে চেনা প্রতিপক্ষ। মাশরাফি তোপের পর তামিমের ব্যাটে চড়ে সাদা বলের গ্যালারির দিকে ভেসে যাওয়া, সাকিব-মুশফিকের দৃঢ়তায় একশো বিরানব্বইয়ের ভারতকে মাড়িয়ে ছুটেছিলো টাইগারদের জয়রথ। একটা প্রজন্মের বিদায়ে ব্যাটনটাও কি হাতবদল হলো না তাতে? এই ম্যাচ দিয়েই হয়তো প্রতীকীভাবে বাশার-রফিকদের হাত থেকে মাশরাফি-সাকিব-তামিম নামের এই তরুণ তুর্কীদের হাতে উঠে গেলো বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্বটা। সুপার এইটে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আরেকটি অর্ধশতক; আঠারো পেরুনো মাঝারী উচ্চতার এক বাংলাদেশি পুরো ক্রিকেটবিশ্বকে সেই বসন্তে বার্তা দিয়েছিলেন- “রিমেম্বার দ্যা নেম! সাকিব আল হাসান”…।
২০০৭ সালে মে মাসে চট্টগ্রামে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় সাকিবের।
ক্রিকেট ইতিহাসেই টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি তিন ধরনের ক্রিকেটে একই সময়ে এক নম্বরে থাকা একমাত্র ক্রিকেটার তিনি। ২০১৫ সালে সাকিব এই কৃতিত্ব প্রথম করে দেখান। সাকিব নিজে নিজের এই কৃতিত্ব আবার করে দেখিয়েছেন, যা আর কোনো দেশের ক্রিকেটার পারেননি। আরেকটি অলরাউন্ড কৃতিত্বে সাকিব অনন্য হয়ে আছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে ওয়ানডেতে ৫ হাজার রান ও ২০০ মাইলফলক স্পর্শ করেন। মাত্র ১৭৮টি ওয়ানডে লেগেছে তাঁর। এত দ্রুত এই কৃতিত্ব আর কেউ করতে পারেনি। সাকিব টেস্ট ইতিহাসে তিন অলরাউন্ডারের একজন, একই ম্যাচে সেঞ্চুরি আর ১০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব আছে যাঁদের।
বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ, কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়ের স্পন্দন। একটা জাতি ক্রিকেট নামের খেলাটায় আশায় বুক বাঁধে তাঁর নামে, জয়ের স্বপ্ন দেখে তাঁর চোখে। মেঘে মেঘে বেলা কম হয়নি, খেলাটায় পার করে দিয়েছেন জীবনের অনেকটা সময়, অর্ধেক আয়ুকাল তো দেশের প্রতিনিধিত্বই করছেন। অলরাউন্ডার সম্ভবত তিন রকমের হয়, গড়পড়তা, খুব ভালো, আর সাকিব আল হাসান।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন