ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় অধিবাসী ক্লিফিন ফ্রান্সিস তখন বাড়িতে বসেই বন্ধুর সাথে কথা বলছিলেন। তার বন্ধু জানতে চেয়েছিলেন, ক্লিফিন এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপের খেলাগুলো দেখবে কিনা।
তার উত্তর ছিল, “অবশ্যই। আমি এমনকি রাশিয়া চলেও যেতে পারি খেলা দেখতে।”
সেটা ছিল গত বছর আগস্টের ঘটনা। তখনো তার মাথায় ছিলনা কীভাবে বিমান টিকেট যোগাড় হবে কেরালা থেকে রাশিয়া যাবার জন্য।
পেশায় শিক্ষক তবে তার স্থায়ী চাকরি নেই। গণিতের ফ্রিল্যান্সিং শিক্ষক হিসেবে তার আয় দিনে প্রায় ৪০ ডলারের মতো।
“আমি অনুধাবন করলাম রাশিয়ায় যাওয়া ও এক মাস সেখানে থাকার জন্য আমার যথেষ্ট টাকা নেই। তারপরেই নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকি যে কমদামে কি উপায় হতে পারে। আর এটার উত্তর ছিল বাইসাইকেল।” বললেন ক্লিফিন।
আর এতো কষ্টের চিন্তার একটাই কারণ সেটি হলো পুরস্কার হিসেবে সেখানে মিলতে পারে লিওনেল মেসিকে দেখার সুযোগ।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “আমি সাইকেল ভালোবাসি ও ফুটবল পাগল। শুধু এ দুটোরই সমন্বয় ঘটিয়েছিলাম আমি।”
প্রথমে পরিকল্পনা করেছিলেন যে পাকিস্তান হয়ে যাবেন কিন্তু পরে সেটি বাদ দেন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাকর সম্পর্কের কারণে।
ফুটবল এবং ফিল্ম
পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনার জন্য কিছুটা মূল্যও দিতে হয় ক্লিফিনকে। যেমন দুবাইতে নিজের সাইকেল নিতে পারেননি বরং সেখানে আরেকটি কিনতে হয়েছে প্রায় সাতশ ডলার খরচ করে।
অনেক পথ পাড়ি দিয়ে তিনি ১১ মার্চ ইরানের বান্দার আব্বার বন্দরে প্রবেশ করেন।
“এটা বিশ্বের চমৎকার একটি দেশ এবং মানুষগুলোও চমৎকার। ৪৫ দিন ওখানে কাটিয়েছি অথচ এর মধ্যে হোটেলে ছিলাম মাত্র দু দিন।” বলেন তিনি।
আসলে ইরানের যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই স্থানীয়দের অতিথি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
“ইরান সম্পর্কে আমার ধারণাই বদলে গেছে। আসলে ভূ রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে কোনো দেশ সম্পর্কে ধারণা করাই উচিত নয়।” বলছেন ভারতীয় যুবক।
তিনি বলেন, “ইরানীরা আমার কাছ থেকে কথা নিয়েছে যে রাশিয়ায় ইরান দলকে সমর্থন যোগাবো। আর তারাও বলিউডের সিনেমা পছন্দ করে। আসলে এটিই আমাকে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে সহায়তা করেছে।”
সাইক্লিং করে চেহারাই পরিবর্তন
ইরান থেকে তিনি সাইকেল চালিয়ে যান আজারবাইজান। কিন্তু সমস্যায় পড়েন সীমান্তে।
কারণ পাসপোর্টে যে ছবি আছে সেটি দেখে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না সীমান্ত পুলিশের।
“কারণ অতিমাত্রায় সাইক্লিং এর কারণে ততদিনে আমার ওজন প্রচুর কমে গিয়েছিল। পাসপোর্টের ছবির মতো আমাকে দেখাচ্ছিল না। আট ঘণ্টা সময় নিয়ে পুলিশ আমার তথ্যাদি যাচাই করেছে। যদিও তারা বেশ ভালো আচরণই করেছিল আমার সাথে।” বলেন ক্লিফিন।
আজারবাইজানেও হোটেল এড়াতে নিজের বহন করা তাঁবুতেই অবস্থান করেছেন তিনি।
আটকে ছিলেন নো ম্যানস ল্যান্ডে
এরপর যখন জর্জিয়াতে পৌঁছালেন তখন ফ্রান্সিসকে আর সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছিল না।
ফলে তার পরিকল্পনায় আরও কিছু পরিবর্তন আনতে হয়।
“সব ডকুমেন্টস ছিল আমার। তারপরেও জানি না কেন আমাকে অনুমতি দিল না তারা। তারা বিপদেই ফেলে আমাকে কারণ আজারবাইজানের জন্য আমার সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিসা ছিল।”
এরপর পুরো একদিন তিনি আটকে থাকেন জর্জিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে নো-ম্যানস ল্যান্ডে। পরে জরুরি ভিসা পান আজারবাইজানে পুনরায় প্রবেশের জন্য।
তিনি বলেন, “পরে আরেকটি রুট বের করি রাশিয়ায় যাওয়ার জন্য। লোকজন বলে আজারবাইজানের সাথে রাশিয়ার দাগেস্তান অঞ্চলের স্থল সীমান্ত আছে। সেখানেই যাই আমি। কিন্তু জায়গাটা ঠিক নিরাপদ মনে হলো না। কিন্তু আমার ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। ৫ জুন দাগেস্তানে প্রবেশ করি।”
ভাষা ছিল বড় একটি সমস্যা, কারণ লোকজন ইংরেজি বুঝতো না।
“বরং একজন ভারতীয়কে সাইকেলে করে তাদের এলাকায় প্রবেশ করতে দেখে তারা অবাক হয়। এখানে আবার সেই ফুটবল আর সিনেমাই আমাকে তাদের সাথে সহজ করে তোলে।” বলছিলেন ক্লিফিন।
এরপর তিনি সেখান থেকে যান তামভবে যেটি মস্কো থেকে সড়কপথে ৪৬০ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু তাকে যেতে হবে মস্কো ২৬ জুনের ফ্রান্স বনাম ডেনমার্কের খেলা দেখতে কারণ ওই একটি খেলার টিকেটই তার আছে।
তিনি বলেন, “কিন্তু আমি সমর্থন করি আর্জেন্টিনা এবং লিওনেল মেসি আমার প্রিয়। তাকে পুজো করি আমি। তার সাথে দেখা করা আর তাকে আমার সাইকেলে একটা অটোগ্রাফ দেয়ার কথা বলাটাই আমার স্বপ্ন।”
ক্লিফিন ফ্রান্সিসের আশা, একদিন তার দেশ ভারতও বিশ্বকাপ খেলবে আর সেটি হলে আগামী দুই দশকের মধ্যেই।
তিনি বলেন, রাশিয়ার পথে তার যাত্রার এ গল্প পড়ে যদি একটি শিশুও সাইক্লিং ও ফুটবল নিয়ে আগ্রহী হয় তাহলেই তিনি সার্থক।
নিউজবাংলাদেশ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন