ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফিকে বলা হয় ‘অহংকার বর্জিত উল্লাসের দৃশ্য’। তামাম দুনিয়ায় সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত, লোভনীয় ও প্রতীক্ষিত ট্রফিটির নাম কি? যে কেউ একবাক্যে উত্তর দেবে ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি। গত ৮৮ বছরে ২০ বার এই ‘অহংকার বর্জিত উল্লাসের দৃশ্য’ দেখেছে পৃথিবী। রাশিয়া ২১তম উল্লাসের সাক্ষী হতে চলেছে।
ফুটবল বিশ্বে এখন কোটি টাকার প্রশ্ন- কে জিতবে বিশ্বকাপ। কার হাতে উঠবে সেই সোনার পাতে মোড়ানো স্বপ্নের ট্রফি। মেসি, নেইমার, রোনালদো নাকি অন্য কারও হাতে। এমন প্রশ্নে, শঙ্কা আর উত্তেজনায় রাশিয়ায় চলেছে বিশ্বকাপ আসর।
তবে এই ফাঁকে কৌতুহলী পাঠকের মনোযোগী আকর্ষণ করা যাক। যে বিশ্বকাপ নিয়ে এত হইহুল্লোড় সেটি কিভাবে তৈরি হয়? কারা তৈরি করে? কি কি দেয়া হয়? ওজন কতটুকু? মূল্য কেমন?
ফুটবল বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক এই ট্রফি নিয়ে প্রতিবেদনে পাঠকের জন্য খুঁটিনাটি কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো:
চার বছরে ফিফাকে একটা করে রেপ্লিকা ট্রফি বানাতে হয়। কারণ, মূল যে ট্রফিটা সেটা ‘ভয়ানক সুরক্ষিত’ একটা সম্পদ। এটা জুরিখের সদর দফতর আর ফিফা ফাইনালের মাঠ ছাড়া আর কোথাও যায় না। এমনকি বিজয়ী দলও এই ট্রফি পায় না স্থায়ীভাবে। তাদেরকে এর বদলে বানিয়ে দেয়া হয় একটা রেপ্লিকা ট্রফি। সেই রেপ্লিকাকে অবশ্য ‘নকল’ বলে মনে করার কোনো সুযোগ নেই। সেটাও মূল ট্রফির মতো সোনার পাতে মোড়ানো, একই আকার ও একই ওজনের একটা ট্রফি।
তাহলে কোথায় কিভাবে এই ট্রফি তৈরি হয়? কোথায় তৈরি হয়েছিলো প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি?
এই সবকিছুর উত্তর ইতালির মিলান শহরের জিডিই বারতোনি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির শিল্পী সালভিও গাজ্জানিগাই ১৯৭১ সালে ডিজাইন করেন বর্তমান ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফিটি। সেই থেকে এই প্রতিষ্ঠানই দেখভাল করে আসছে এই ট্রফিটি। তারাই তৈরি করে সব রেপ্লিকা।
আমরা যে ট্রফিটা এখন দেখতে পাই, এটা আসলে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় ট্রফি। ফিফা বিশ্বকাপে শুরু থেকে ব্যবহৃত হতো জুলেরিমে ট্রফি নামে একটা ট্রফি। একেবারে শুরুতে এর নাম ছিল ‘ভিক্টোরি’ বা ‘কোউপ ডু মোন্ডে’। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ শুরু হলেও ১৯৪৬ সালে সাবেক ফিফা সভাপতি জুলে রিমের নামে এই ট্রফির নামকরণ করা হয়। এই ট্রফির ডিজাইন করেছিলেন ভাস্কর আবেল লাফলেউর।
১৯৩৮ সালে বিশ্বযুদ্ধের সময় ট্রফিটা ছিল বিজয়ী দল ইতালির কাছে। নাত্সী বাহিনীর হাত থেকে রক্ষার জন্য ফিফার সহ-সভাপতি অট্টোরিনো বারাসিস এটি ব্যাংক থেকে তুলে রোমে নিয়ে যান। লুকিয়ে রাখেন একটা জুতার বাক্সে। আবার ১৯৬৬ বিশ্বকাপের মাত্র চার মাস আগে লন্ডনে এক উন্মুক্ত প্রদর্শনী অনুষ্ঠান থেকে চুরি হয়ে যায় এই বিশ্বকাপ। সাত দিন পর খবরের কাগজে মোড়ানো অবস্থায় লন্ডনের নরউড অঞ্চলের সাবারবেন বাগান থেকে একে উদ্ধার করে পিকেলস নামের একটি কুকুর।
কুকুরটির মালিক ডেভিড করবার্টকে অবশ্য এর জন্য ছয় হাজার পাউন্ড পুরস্কৃত করা হয়। আর ট্রফিটির বিনিময়ে ১৫ হাজার পাউন্ড দাবি করা চোরকে দেওয়া হয় দু’বছরের জেল। ১৯৭০ সালে তিনবার বিশ্বকাপ জয়ের পর এটা চিরতরে পেয়ে যায় ব্রাজিল।
কিন্তু ১৯৮৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর আবারও চুরি হওয়ার পর আর কোনো হদিস মিলেনি ট্রফিটির। ধারণা করা হয় ট্রফিটি এর মধ্যে গলিয়ে ফেলা হয়েছে। তাই আর সেটাকে খুজেও লাভ হয়নি।
১৯৭৪ সালে এসে বিশ্বকাপের ট্রফি বদলের সিদ্ধান্ত নেয় ব্রাজিল। সাতটি দেশ থেকে ৫৩টি ডিজাইন এসে জমা পড়ে। তবে সবাইকে পাশ কাটিয়ে বিজয়ী হয়ে যান জিডিই বারতোনির শিল্পী সিলভিও গাজ্জানিগা।
প্রথমে এর পুরোটা সোনা দিয়ে তৈরির পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক মার্টিন পোলিয়াকফ মত দেন এত স্বর্ণ দিলে এর ওজন হবে প্রায় ৭০ কেজি। এত ভারী ট্রফি তুলতে তো ফুটবলার নয়, লাগবে ভারোত্তোলক। তাই ট্রফির উপরের গোল অংশটি ফাঁপা করে বানানোর সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা।
সিলভিও গাজ্জানিকা নিজেই এই ট্রফির মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ক্রীড়া ও বিশ্ব ক্রীড়ার যে সমন্বিত সুর, তাকে ধরতে গিয়ে আমি দুটো মৌলিক ছবি মাথায় রেখেছিলাম। একজন অ্যাথলেটের জয় ও বিশ্ব। আমি জানতাম, এই কাজটিতে এমন কিছু দৃঢ় লাইন থাকতে হবে, যাতে একজন ফুটবলারের জয় বোঝায়, কিন্তু সেটা সুপার হিউম্যানের ইগো ছাড়াই; একটা মানুষ তার জয়োল্লাস করছে। একজন ক্রীড়া নায়ক, যে বিশ্বকে জড়িয়ে ধরেছে। এটা একজন ক্রীড়াবিদের দিনের পর দিনের ত্যাগ ও পরিশ্রমকে চিত্রায়িত করবে এবং তার সতীর্থদের চিত্রায়িত করবে।’
ট্রফিটির দিকে যদি সূক্ষ্ম মনোসংযোগ করা যায় তবে দেখবো- এখানে দুজন ফুটবলার দুই পাশ থেকে উঠে এসে হাতে হাত রাখার চেষ্টায় উল্লাস করছেন। তাদের হাতে বাঁধা পড়েছে বিশ্ব। এ যেনো ফুটবলেরই প্রতীক, এ যেনো বিশ্বকাপেরই প্রতীক। ফিফা ঠিক এমনই একটা ভাতৃত্ববোধ ও জয়ের স্লোগানই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো। তাদের সেই ফেয়ার প্লে ও জয়ের চেয়েও বড় খেলা; এই মূল বোধের সাথে ট্রফির এমন মিল হওয়াতে এই ট্রফিকেই বেছে নিয়েছিল ফিফা।
১৪.৫ ইঞ্চি লম্বা, ৬.১৪২ কেজি ওজনের একটা অসাধারণ শিল্পসম্মত ট্রফি; যা তৈরি হবে ১৮ ক্যারেট সোনা দিয়ে। কারা তৈরি করবে এটা। যেহেতু গাজ্জানিগা নিজে এরকম একটা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত, তাই তাদের প্রতিষ্ঠান জিডিই বারতোনিকেই ফিফা দায়িত্ব দিলো এই ট্রফি তৈরি করার।
জিডিই বারতোনি আগে থেকেই খ্যাত ছিলো বিভিন্ন মূলবান ট্রফি ও মেডেল তৈরি করার জন্য। সেই ১৯০০ সালে ইতালির মিলান শহরে যাত্রা শুরু করে হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান বারতোনি। ১৯৪৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেন ড. এউগেনিও লোসা। তিনি এমিলিও বারতোনির সাথে মিলে প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নেন। কয়েক বছরের মধ্যে অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির পুরো মালিকা কিনে নেন ড. লোসা।
১৯৬০ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি রোম অলিম্পিকের সব মেডেল ও স্মারক সরবরাহের দায়িত্ব পায়। সেবার এই সব ডিজাইনের দায়িত্বে ছিলেন ভাস্কর এমিলিও গ্রেসো। এই ইভেন্টই বারতোনিকে পরিচিত করে তোলে বিশ্বব্যাপী। এরপর ইউরোপ ও আরবের বেশ কিছু দেশে বড় বড় ক্রীড়া ইভেন্টের দায়িত্ব পেতে থাকে তারা।
১৯৭১ সালে এই কোম্পানির ইতিহাস বদলে যায়। ফিফার আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় তারা। আর সেখানে নতুন ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি তৈরির জন্য বিজয়ী হয় ভারস্কর সিলভিও গাজ্জনিগার ডিজাইন। আর এভাবেই তারা জড়িয়ে পড়ে ফিফার সাথে।
এরপর বিভিন্ন সময় তারা তৈরি করেছে ১৯৮০, ১৯৯২ অলিম্পিকের পদক। তৈরি করেছে ১৯৯০, ২০০৬ সালের বিশ্বকাপের মেডেলও। এ ছাড়া তারা তৈরি করেছে চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইউরোপা লিগের ট্রফিও।
প্রতি চার বছর বাদে বাদে জিডিই বারতোনিতে ফিরে আসে মূল ফিফা বিশ্বকাপ। এখানে সিলভিও গাজ্জনিগা যতদিন জীবিত ছিলেন, সরাসরি তার তত্ত্বাবধায়নে পরিষ্কার ও সংস্কার করা হতো মূল ট্রফির। ট্রফি যেনো কিছু্তেই বিকৃত বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এটা দেখাটা এখানকার শিল্পী ও কর্মীদের মূল চ্যালেঞ্জ থাকে। অত্যন্ত যত্নের সাথে এই কাজ করার পাশাপাশি আরও একটা কাজ করতে হয় বারতোনিকে। এখানেই অত্যন্ত যত্নের সাথে তৈরি হয় রেপ্লিকাও।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন