হংকং রাগবি সেভেন টুর্নামেন্ট উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন। সেখানে পৌঁছেই বাংলাদেশ, নেপাল, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের সাংবাদিকদের নজর আটকে গেল একজনের দিকে। মুহূর্তেই যেন রাগবি টুর্নামেন্টের কথা মাথা থেকে হাওয়া। অতিথিদের কাতারে বসে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের কিংবদন্তি স্টিভ ওয়াহ। সংবাদ সম্মেলন শেষ হতেই ভোঁ দৌড়। অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট আটকা পড়ে গেলেন ১২-১৩ জন সাংবাদিকের মাঝে।
অনাগ্রহ বা বিব্রতবোধ করেননি অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের একসময়ের নায়ক স্টিভ ওয়াহ। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের নাম শুনতেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে সোজা চলে গেছেন ক্রিকেটীয় আলোচনায়। অস্ট্রেলিয়ার একটি রাগবি ক্লাবের উপদেষ্টা হিসেবে হংকংয়ে প্রচারণা চালাতে আসা বিশ্বকাপজয়ী এই অজি অধিনায়কের আলোচনার সবটা জুড়ে থাকে ক্রিকেট।
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের জৌলুসের অধ্যায়ে স্টিভ ওয়াহর নামটি লেখা সোনালি অক্ষরে। ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অধিনায়কদেরও একজন তিনি। ৩২টি টেস্ট সেঞ্চুরির মালিক, সাবেক নম্বর ওয়ান ব্যাটসম্যান ওয়াহ প্রিয়.কমের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া দলের বল টেম্পারিং, বাংলাদেশের ক্রিকেট, বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা ও রাগবি নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শান্ত মাহমুদ।
প্রিয়.কম: কেমন আছেন?
স্টিভ ওয়াহ: ভালো আছি। রাগবির এমন আয়োজনের মাঝে ভালো না থেকে উপায় নেই। তবে আপনি খুব নাছোড়বান্দা। অবশ্য জার্নালিস্টরাই এমন হয় (হেসে)।
প্রিয়.কম: খুব বেশি নয়, কয়েকটি প্রশ্ন ছিল। যদি উত্তর দিতেন...
স্টিভ ওয়াহ: এ জন্যই আমার সেক্রেটারি আমাকে রাজি করাতে পেরেছেন। না হলে সম্ভব ছিল না। আমার সেক্রেটারি বলছিলেন, আপনি ঘ্যানঘ্যান করছেন।
প্রিয়.কম: অস্ট্রেলিয়া দলের বল টেম্পারিংয়ের ব্যাপারটা শোনার পর দেশটির সাবেক একজন অধিনায়ক হিসেবে ঠিক কেমন লেগেছে আপনার?
স্টিভ ওয়াহ: শোনার পর আমার অবস্থা কেমন ছিল, সেটা বর্ণনা করা সত্যিই কঠিন। আসলেই কঠিন ছিল আমার জন্য। একজন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক বলে নয়, একজন অস্ট্রেলিয়ান বা এই দেশের ক্রিকেটের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে এমন খবর কেউই শুনতে চায় না। ক্রিকেট খেলা দলগুলোর মধ্যে আমরা অনেক পুরনো। আমাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য আছে। এটা মাঠের খেলা। ব্যাট ও বল দিয়ে খেলতে হয়। এই দুটি জিনিসের বাইরে কোনো কিছু দিয়ে ক্রিকেট খেলা যায় না। এখানে সেটাই হয়েছে। অন্য জিনিসের ব্যবহার হলে সেটা আর ক্রিকেট থাকে না। তাই সেখানে নীতির ব্যাপারটাও খুঁজে পাওয়া কঠিন।
১৯৯৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ। ছবি: সংগৃহীত
১৯৯৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ। ছবি: সংগৃহীত
প্রিয়.কম: এই ইস্যুতে আপনার মতামত কী ছিল?
স্টিভ ওয়াহ: অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই ইস্যুতে এর আগে আমাকে বেশ কয়েকবার এবং অনেক কথা বলতে হয়েছে। আমি একই কথা বলব, এমন খবর শোনাটা আমার জন্য কষ্টের, একই সঙ্গে বিব্রতকর ছিল। ওই ঘটনার পর আমি অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। এই ঘটনায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রিকেটভক্তদের থেকে আমি কয়েক হাজার মেসেজ পেয়েছি। তারা সবাই মর্মাহত। তাদের মেসেজের উত্তর ছিল না আমার কাছে। বেশি কিছু বলতে পারিনি। এটা বড় অন্যায়। আমাদের সংস্কৃতিতে এসব ব্যাপার নেই। এমন ঘটনা সত্যিই হতাশার ও বিব্রতকর।
প্রিয়.কম: স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার ও ক্যামেরন ব্যানক্রফটের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়েছে। অনেকে বলছেন বেশি। আবার অনেকে বলছেন ঠিকই আছে। আপনার দৃষ্টিতে শাস্তির পরিমাণ ঠিক আছে কি না?
স্টিভ ওয়াহ: আমি আগেই বলেছিলাম, ক্রিকেটের ভালোর জন্য এবং ক্রিকেটভক্তদের ভরসা ও বিশ্বাসের মূল্য দিতে সব ধরনের সিদ্ধান্তের পক্ষে আমি থাকব। আমার অবস্থান এখনো সেটাই। এ নিয়ে আর কিছু বলার নেই।
অধিনায়কত্ব সামলানোর পাশাপাশি স্টিভ ওয়াহ নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন নাম্বার ওয়ান ব্যাটসম্যান হিসেবে। ছবি: সংগৃহীত
অধিনায়কত্ব সামলানোর পাশাপাশি স্টিভ ওয়াহ নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন নাম্বার ওয়ান ব্যাটসম্যান হিসেবেও। ছবি: সংগৃহীত
প্রিয়.কম: লম্বা সময়ের জন্য এদের না পাওয়াটা অস্ট্রেলিয়া দলের জন্য কতটা ক্ষতির? বিশেষ করে স্টিভ স্মিথের না থাকা। তিনি অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক ছিলেন, বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানও। সব মিলিয়ে কী বলবেন?
স্টিভ ওয়াহ: দেখুন, অস্ট্রেলিয়া দল একজনের ওপর কখনোই নির্ভর করেনি। এখনো করে না। যেকোনো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে, যেকোনো কন্ডিশনে জেতার সামর্থ্য তাদের আছে। এই দলের ওপর আমার ভরসা আছে। যদিও কিছু ক্রিকেটার আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কথা ভুলে গেছে হয়তো। একজন না থাকলে ক্রিকেটের ক্ষতি হবে—এমনটি মনে করি না আমি। তবে হ্যাঁ, কারো কারো অনুপস্থিতি নিশ্চয়ই একটা দলকে ভোগাতে পারে। কিন্তু পেশাদার দল সেদিকে কখনোই দৃষ্টি দেয় না।
প্রিয়.কম: এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে দুই-একটা প্রশ্ন। বাংলাদেশের ক্রিকেট দেখে কী মনে হয়? এই বাংলাদেশ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
স্টিভ ওয়াহ: অস্ট্রেলিয়া কিন্তু মাত্র কয়েক দিনে অস্ট্রেলিয়া দল হয়ে উঠেনি, এতগুলো বিশ্বকাপ জেতেনি। ক্রিকেট ব্যাপারটাই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ও বাস্তবায়নের। হয়তো সেটারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ বড় রাস্তায় উঠে গেছে। সেই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বাংলাদেশ দৌড়াতেও শুরু করবে বলে আমার বিশ্বাস। তারা ঘরের মাঠে বেশ শক্ত দল। এই ব্যাপারটাই বাইরের মাঠে নিয়ে যেতে হবে। আর পেস বোলিং করতে ও খেলতে শিখতে হবে। শুধু স্পিন দিয়ে লড়াই করে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি সেভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের খোঁজ না রাখতে পারলেও এই ব্যাপারগুলো অন্তত জানি।
প্রিয়.কম: অস্ট্রেলিয়া যখন বাংলাদেশে যেতে চাচ্ছিল না, বাংলাদেশের ক্রিকেটভক্তরা বলছিল, হারের ভয়ে অস্ট্রেলিয়া আসছে না। কিছু বলবেন এ নিয়ে?
স্টিভ ওয়াহ: হা-হা-হা, আসলেই নাকি? আমার মনে হয় না, তারা মন থেকে এমন বলেছে। আর সমর্থকদের এমন কথা ধরে লাভ নেই। সবাই নয়, তাদের মধ্যে অনেকেই এমন কথা বলে। তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশ এখন আর নিশ্চয়ই দুর্বল প্রতিপক্ষ নয়। তারা জিততে শিখে গেছে। আমার মনে হয় না কোনো দলই এখন বাংলাদেশকে হালকাভাবে নেয়। বিশেষ করে ঘরের মাঠে তাদের যারা দুর্বল ভাববে, তারা ভুল করবে। তবে তাদের টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে আরও ভাবা উচিত। তরুণ খেলোয়াড়দের সেভাবেই তৈরি করে তোলা উচিত।
ক্রিকেটকে বিদায় বলার দিনে সতীর্থদের কাঁধে স্টিভ ওয়াহ। ছবি: সংগৃহীত
ক্রিকেটকে বিদায় বলার দিনে সতীর্থদের কাঁধে অশ্রুসিক্ত স্টিভ ওয়াহ। ছবি: সংগৃহীত
প্রিয়.কম: বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাকে নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
স্টিভ ওয়াহ: মাশরাফি যতটা ভালো বোলার, তার চেয়ে ভালো একজন নেতা। এই ব্যাপারটিই তাকে এবং বাংলাদেশ দলকে সাফল্য এনে দিয়েছে বলে আমার মনে হয়। একটি দেশের ভার একজন যোগ্য নেতার হাতে থাকা কতটা জরুরি, এটা সবাই বুঝতে পারে। মাশরাফি সেই কাজটাই করে দেখিয়েছে। তাকে সত্যিকারের নেতা বলা ভুল হবে না।
প্রিয়.কম: ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে পছন্দ করতে বললে কার কথা বলবেন?
স্টিভ ওয়াহ: আসলে আমি সেভাবে নাম জানি না বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটারদের। তাই বলতে পারছি না। তবে সাকিব খুব ভালো পছন্দ।
প্রিয়.কম: রাগবি কেমন উপভোগ করছেন? ক্রিকেট ও রাগবির চারপাশের পরিবেশের মধ্যে কতটা পার্থক্য খুঁজে পান?
স্টিভ ওয়াহ: আসলে আমাদের কাছে ক্রিকেটের চেয়ে বেশি উপভোগ্য কিছু নেই। যত যাই হোক, শেষটা ওই ক্রিকেটই। তবে রাগবিও উপভোগ করি। না হলে এটা নিয়ে কাজ করা সম্ভব ছিল না। অস্ট্রেলিয়াতে রাগবি দারুণ জনপ্রিয়। ক্রিকেট ও রাগবি খেলার মধ্যে যেমন অনেক পার্থক্য, তেমনি এই দুই খেলার মাঠ ও মাঠের বাইরে পরিবেশও ভিন্ন। দর্শকরাও ভিন্ন বলতে পারেন। রাগবির দর্শকরাও অনেকটা রাগবি খেলোয়াড়দের মতো, আক্রমণাত্মক একটা ভাব দেখা যায়। কিন্তু ক্রিকেট তেমন নয়।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন