প্রচণ্ড প্রাণে ভরা এক খেলোয়াড়। থামের মতো দুই উরু। পায়ে প্রবল শক্তি। ক্লান্তি শব্দটা অভিধানে নেই। যখন তখন যেকোন যায়গা থেকে শট নিয়ে প্রতিপক্ষকে কাঁপিয়ে দিতেন। ফ্রি কিকে ইতিহাস গড়েছিলেন। লেফট উইং-ব্যাক হিসেবে খেলতেন। ওভার ল্যাপ করে উল্টো দিকের সীমানার দখল নিতেন চোখের পলকে। ব্রাজিলের হয়ে রবার্তো কার্লোস তিন বিশ্বকাপে খেলেছেন ১৭টি ম্যাচ। দুটি ফাইনালে খেলেছেন, একটিতে জিতে শিরোপায় খেয়েছেন চুমু। ফিফার ১৯৯৮ ও ২০০২ টুর্নামেন্টের সেরা একাদশে ছিলেন। ২০০৬ বিশ্বকাপটা অবশ্য সুখে যায়নি। তারপরই নিয়েছিলেন অবসর। সেবার ফ্রান্সের জয়সূচক গোলটির জন্য ফ্যান ও মিডিয়া দুষেছিল তাকে। বিশ্বকাপের ইতিহাসের ১০০ সেরা কিংবদন্তির তালিকায় আজ কার্লোস। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের ১০০ দিনের কাউন্টডাউনের উৎসবের আয়োজন এটি। ধারাবাহিকভাবে লিখছেন খাইরুল আমিন তুহিন।
ব্রাজিলের আর দশজন ফুটবলারের চেয়ে ছেলেবেলাটা খুব ভিন্ন নয় রবার্তো কার্লোসের। দারিদ্রের সাথে স্প্রিন্ট প্রতিযোগিতা করতে করতেই বেড়ে ওঠা। এইটুক বয়সে পেটের দায়ে ফ্যাক্টরিতেও নিতে হয়েছিল কাজ। কিন্তু ওই যে স্প্রিন্ট লড়াই, ওটাই বুঝি এগিয়ে থাকার প্রেরণা ছিল। ফরোয়ার্ড হিসেবে ফুটবলে শুরু। কিন্তু একদিন ভূমিকা বদলে ডিফেন্ডার। তাহলে দারিদ্রের সাথে ওটা ছিল প্রতিরোধের লড়াই মাত্র?
নাহ। মোটেও তা নয়। আসলে ফরোয়ার্ড ও ডিফেন্ডারের যোগফলে যা হওয়া সম্ভব সেটাই ছিলেন কার্লোস। এবং দুইয়ের মিলনে এমন এক স্বতন্ত্র খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্ব কাঁপিয়েছিলেন যে ফুটবল ইতিহাসে তার কোনো জুড়ি নেই। ব্রাজিলের সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার। বিশ্বেরও। তাকে বর্ণনা করতে গিয়ে পণ্ডিতরা একবাক্যে মেনে নেন, কার্লোসই 'ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি আক্রমণমনষ্ক লেফট-ব্যাক'।
'ইল হোমব্রে বালা' ছিল তার ডাকনাম। গতি ছিল দারুণ। শটও নিতেন তেমন। তাই এই 'বুলেটমানব' নাম। বড্ড আদুরে ফ্যানদের কাছে। কিন্তু প্রতিপক্ষের কাছে সন্ত্রাস। ঘণ্টায় প্রায় ১০৫ মাইল (১৬৯ কিলোমিটার/ঘণ্টা) গতিতে উড়ে যেত কার্লোসের নেওয়া বাঁকানো শটের বল। স্ট্যামিনা, দৌড়ের গতি, টেকনিক্যাল স্কিল, দুর্দান্ত সব ক্রস, নিচু থ্রো ইন এবং ২৪ ইঞ্চি (৬১ সেন্টিমিটার) উরুর জন্য বিখ্যাত ছিলেন এই প্রাণময় ব্রাজিলিয়ান। ফিফার ওয়ার্ল্ড কাপ ড্রিম টিমে ছিলেন তিনি। পেলের গড়া ১০০ জীবিত কিংবদন্তি ফুটবলারের তালিকাতে মিস পড়েনি নামটা। ফুটবল ইতিহাসে তার প্রভাব বোঝাতে এর বেশি কিছু না বললেও চলছে।
ফ্রি কিকের প্রসঙ্গ আসলে কার্লোসের নাম আসবেই। ১৯৯৭ সালে ফ্রান্সের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে একটি ফ্রি কিকে গোল করেছিলেন। ওটাকে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ধরা হয়। বল যেভাবে হাওয়ায় বাঁকিয়ে জালে পাঠিয়েছিলেন তা ছিল রূপকথার মতো। সেটি ছিল তুরনয় দি ফ্রান্স আসরের প্রথম ম্যাচ। ৩ জুন। প্রায় ৩৫ মিটার বা ১১৫ ফুট দূর থেকে ডান পাশের মাঝামাঝি জায়গার কাছ থেকে শট নিয়েছিলেন। বিখ্যাত বাঁ উরুর পায়ে। বলটা কিভাবে বাঁক নিয়েছিল তা বোঝাতে একটা কথা বলা যায়। বল বয় ডান পাশের বারের ১০ ফুট দূরে ছিলেন। বল আসতে দেখে ডাক করেছিলেন ইনস্টিংকের কারণে। তার গায়ে আঘাত হানবে ভেবেছিলেন। কিন্তু সেই বল সবার চোখ কপালে তুলে দিয়ে লক্ষ্যের দিকে উড়ে যায়। গোলকিপার ফাবিয়েন বার্থেজও কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যান। করণীয় না বুঝে জায়গাতেই নিশ্চলপ্রায় দাঁড়িয়ে থাকেন। ২০১০ সালে ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীদের একটি দল ওই বলের কক্ষপথ বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যা করে একটি পেপার প্রকাশ করেছিল। 'ব্যানানা কিক' এর শেষ কথার মতোই ছিল ওই গোলটা।
দেশের পক্ষে ২১ বছর বয়সে অভিষেক। ১২৫ ম্যাচে ১১ গোল নিয়ে অবসর। তিনটি বিশ্বকাপ, চারটি কোপা আমেরিকা, একটি কনফেডারেশন্স কাপ ও একটি অলিম্পিকে দেশের পতাকা বয়ে বেড়ানোর গৌরব কার্লোসের। স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের ডিফেন্সের প্রাণ হয়ে ছিলেন ১১টি মৌসুম। দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে স্পেনে খেলেছেন। তাতেই বোঝা যায় ক্লাবের কাছে তার গুরুত্ব।
যে তিনটি বিশ্বকাপে কার্লোস খেলেছেন সেগুলোতে তাকে ছাড়া ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দলই চিন্তা করা যেত না। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের কাছে ফাইনালের হারসহ ৭টি ম্যাচ খেলেছিলেন। ২০০২ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের শেষটায় প্যারাগুয়ের গোলকিপার হোসে লুই চিলাভার্ট কার্লোসের গায়ে থুতু ছিটিয়েছিলেন। ফিফার দেওয়া তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচটিতে বসে থাকতে হয়েছিল চিলাভার্টকে।
২০০২ বিশ্বকাপ জিতল ব্রাজিল। 'থ্রি আর' রোনালদিনহো, রোনালদো ও রিভালদোর সাথে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত নাম ছিল রবার্তো কার্লোস। নামের শুরুটা ধরে অনেকে অবশ্য তখন 'থ্রি আর' না হয়ে কেন 'ফোর আর' হবে না সেই আলোচনা তুলেছিলেন। চীনের বিপক্ষে ওই বিশ্বকাপে ফ্রি কিক থেকে একটি গোল করেছিলেন কার্লোস। বিশ্বকাপে তার ওটাই একমাত্র গোল। জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে ব্রাজিলের ২-০ গোলের জয়ের একাদশে থেকে শেষ করেছিলেন। সেবার বিশ্বকাপের অল-স্টার দলেও ছিলেন কার্লোস।
এরপরের বিশ্বকাপটাকে অবশ্য কার্লোস সেভাবে মনে রাখতে চাইবেন না। ২০০৬ এর জুলাই। ফ্রান্সের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল। ১-০ গোলের হারে ব্রাজিলের বিদায়। এবং এরপরই অবসরের ঘোষণা দিয়ে রবার্তো কার্লোস বলেছিলেন, 'জাতীয় দলে খেলা আমি বন্ধ করে দিলাম। এটা আমার শেষ ম্যাচ ছিল।' তিনি বলেছিলেন, ফ্যান ও ব্রাজিলের মিডিয়ার অন্যায় সমালোচনার কারণে তার এই সিদ্ধান্ত।
ম্যাচে জিনেদিন জিদানের ফ্রি কিক উড়ে এসেছিল বক্সে। থিয়েরি অঁরির মার্কার ছিলেন কার্লোস। কিন্তু অঁরি যখন উড়ে আসা বলে পা ছোঁয়াতে যাচ্ছেন মার্কার কার্লোস ডি বক্সের লাইনের ওপর দুই হাঁটুতে হাত রেখে দাঁড়ানো! শারীরিক অস্বস্তি ছিল। কিন্তু গ্রেটের ওটাই কি না শেষ পর্যন্ত অপরাধ!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন