বই পড়ুয়াদের অনেকের কাছ থেকেই প্রায়ই এ ধরনের একটা কথা শোনা যায়—‘নতুন বইয়ের ঘ্রাণই আলাদা।’
তবে কাগজের বইয়ের পাশাপাশি অনেকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিনির্ভর অডিওবুক বা ই-বুক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন থাকায় মানুষের হাতে ধৈর্য ধরে বই পড়ার সময় খুবই কম। এছাড়া, ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে মনোযোগ ধরে রাখাটাও বেশ কঠিন।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০২১ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, গবেষণায় অংশ নেয়া প্রায় ৪০ শতাংশ আমেরিকান তরুণ গত এক বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে কোনও বই পড়েননি।
এর আগে ২০১৪ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টার ছয় হাজার মানুষের ওপর গবেষণা করেছিলো। সেখানেও উঠে এসেছিলো যে ৩০ বছরের নীচে যাদের বয়স, তাদের ৮৮ শতাংশ তরুণ বছরে মাত্র একটি বই পড়েছে।
তবে তরুণদের মাঝে যারা সত্যিকারের বইপ্রেমী, তারা অবশ্য এখনও বই পড়ছেন। পার্থক্য হলো, তাদের অনেকেই এখন ধীরে ধীরে বইয়ের ডিজিটাল ভার্শনের দিকে ঝুঁকছেন।
গত এক মাস ধরে চলা অমর একুশে বইমেলার দিকে তাকালেও এই বিষয়টি টের পাওয়া যায়।
পাঠকের পছন্দ নয়া মাধ্যম অডিওবুক?
অডিওবুক হলো এমন বই, যা শোনা যায়। আগে যেমন মানুষ টেপ বা সিডিতে গান শুনতো, এটা ঠিক তেমনই। এই অডিওবুকের ধারণা বাংলাদেশে কিছুটা নতুন মনে হলেও সারাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে বেশ পুরনোই।
তবে বাংলাদেশের পাঠকরাও এখন অডিওবুকের সাথে পরিচিত হচ্ছে এবং তারা এটিকে গ্রহণও করছে।
অডিওবুক শোনার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটা শুনতে শুনতে অন্য কাজ করা যায়। যেমন, একজন পাঠক কোনও দীর্ঘ ভ্রমণে যাচ্ছেন; যাত্রাপথে সে তার হেডফোনে অডিওবুক শুনতে পারেন।
আবার, ঘরের কোনও কাজ করার সময় প্লেয়ারে অডিওবুক ছেড়ে দিয়ে নির্বিঘ্নে দুই কাজ একসাথে করা যায়।
এছাড়া, যাদের দীর্ঘক্ষণ বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকতে সমস্যা হয়, তাদের জন্য অডিওবুক আশীর্বাদস্বরূপ।
বাংলাদেশের বইমেলায় গত দুই বছর ধরে অডিওবুকের স্টল থাকলেও এবারই প্রথম একসাথে চারটি অডিওবুকের স্টল দেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো: কাহিনীক, কাব্যিক, শুনবই ও বইঘর।
মেলা প্রাঙ্গণে বিবিসি বাংলার সাথে একাধিক পাঠকের সঙ্গে কথা হয়েছিলো এবং তাদের বেশিরভাগই তরুণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মুনতাসির মাহমুদ সিয়াম আগে থেকেই অডিওবুকের সঙ্গে পরিচিত। তিনি বলেন, "টায়ার্ড লাগলে আমি গল্প শুনতে শুরু করি। তাই, অডিওবুক শোনাটা এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।"
"মাল্টিটাস্কিং এর সময় অডিও বুক আমার প্রথম পছন্দ, কারণ এটা শুনলে কাজে কোনও ব্যাঘাত ঘটে না। প্লাস, বইয়ের পেজ উল্টানো, ভারী একটা বই অনেকক্ষণ ধরে হাতে ধরে রাখা; অডিওবুকে এমন টাইপের ঝামেলা নেই।"
ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়র কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড এঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র মোজাহিদ ইসলামও প্রায় একই অভিমত জানান। তিনি বলেন, "বই পড়ার তো সময় ওভাবে পাই না। তাই আমি যখন বাসে করে ক্যাম্পাসে বা অন্য কোথাও যাবো, এখন থেকে ঐ সময়টাতে অডিওবুক শোনা যাবে।"
তবে অডিওবুকের এমন উদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তরুণদের পাশাপাশি যারা বয়স্ক, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ এবং প্রবাসী বাঙালী, তারাও অডিওবুকের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন।
কাহিনীকের পরিচালক ও কিউরেটর ইমরাদ জুলকারনাইন বলেন, "বয়স হয়ে গেলে তারা বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিতে পারে না, চোখের জ্যোতি কমে আসে। তাই তারা অডিওবুক শুনতে পছন্দ করছেন।"
"আর আমরা যারা ঢাকায় বা বাংলাদেশে আছি, তারা চাইলে কাগজের বই কিনতে পারি। কিন্তু যারা দেশের বাইরে থাকেন, তারা এই সুযোগটা পান না। সেইদিক থেকে অডিওবুক তাদের জন্য খুব ভালো একটা মাধ্যম।"
অ্যাপে কতগুলো বই আছে
অডিওবুকের কথা এলেই 'অডিবল' এর নাম চলে আসে, এটি মার্কিন কোম্পানি অ্যামাজনের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। অ্যামাজন অডিবল অ্যাপে বা ওয়েবে অডিওবুকের পাশাপাশি পডকাস্টও শোনা যায়।
তবে এটার জন্য পাঠককে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সাবসক্রিপশন ফি দিতে হবে।
বাংলাদেশে যে চারটি অডিওবুক প্রকাশনা তাদের যাত্রা শুরু করেছে, তাদেরও অ্যাপ আছে। একশো থেকে আড়াই হাজার পর্যন্ত বইয়ের সংগ্রহ আছে এসব অ্যাপে।
কাহিনীকে অ্যাপে বর্তমানে ১১৬টি অডিওবই রয়েছে, বইঘরে আছে ২০০টি। এছাড়া, শুনবই এবং কাব্যিক অ্যাপে অডিওবইয়ের সংখ্যা আবার হাজারের বেশি।
এসব প্রকাশনা থেকে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে, তারা আরও বইকে অডিওবইয়ে রূপান্তরের জন্য কাজ করছে এবং কোনও কোনও অ্যাপের পেইড ইউজার কয়েক হাজার পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
তবে যেগুলো কালজয়ী বই, অর্থাৎ যেসব বইকে অডিওবইয়ে রূপান্তর করার জন্য মেধাসত্ব লাগে না, এসব অ্যাপে সেসব বইয়ের সংখ্যাই এখনও বেশি। যেমন, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস।
যদিও প্রকাশকরা জানিয়েছেন যে তারা নতুন লেখকদের বইগুলোকেও অডিওবুকে রূপান্তরের চেষ্টা করছেন। তবে নতুন লেখকদের বইয়ের ক্ষেত্রে ঐ বইয়ের প্রকাশকদের সঙ্গে তাদেরকে চুক্তি করতে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ জিনাত শারমিন বলেন, "এখন যারা অডিওবুক নিয়ে কাজ করছে, ওরা প্রকাশনা সংস্থার সাথে চুক্তি করছে।"
"একটি প্রকাশনা থেকে লেখকরা যখন বই বের করছে...অনেক লেখক একইসাথে বইয়ের অডিওবুক, ই-বুক এবং পেপারবুক; তিনটার জন্য আলাদা আলাদা চুক্তি করছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রকাশনার নিজস্ব অডিওবুক বা ইবুক তৈরি করার সক্ষমতা এখনও হয়নি। তাই, যারা অ্যাপভিত্তিক অডিওবুক তৈরি করে, তাদের সঙ্গে তারা চুক্তিগুলো করছে।"
অডিওবুকের ক্ষেত্রে ন্যারেটরের ভূমিকা
অডিওবুকের ক্ষেত্রে ন্যারেটর, অর্থাৎ যিনি গল্পটি পাঠ করেন, তার ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একট ভালো স্টুডিও, টেকনিশিয়ান এবং ন্যারেটর; এই তিনের সমন্বয়ে শ্রুতিমধুর একটি অডিওবুক তৈরি করা সম্ভব।
শুনবই-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও শাহরিয়ার হৃদয় বলেন, "ন্যারেটর ভালো না হলে মানুষ গল্প শুনবে না।"
কাহিনীকের মি. জুলকারনাইনও বলেন যে তারা দেশের প্রথম সারির ভয়েস আর্টিস্টদেরকে নিয়ে কাজ করছেন এবং উচ্চারণগত দিক থেকে সর্বোচ্চ সচেতন থাকছেন।
কিন্তু তবুও কোনও কোনও পাঠক গল্প অ্যাপগুলোতে পাওয়া বইয়ের গল্প বলার ধরণকে পছন্দ করছেন না।
বিবিসি বাংলাকে একাধিক পাঠক জানিয়েছেন, অনুভূতিশূন্য হয়ে গল্প পড়ে গেলে সেটা শুনতে ভালো লাগে না। অডিওবুককে পাঠকের কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়ার জন্য ন্যারেটরের কণ্ঠে প্রয়োজন অনুযায়ী, প্রেম, ভালোবাসা, হাসি, কান্না, ঠাট্টা-তামাশা, অভিমান ইত্যাদি সব ধরনের মানবীয় অনুভূতি উপস্থিত থাকতে হবে।
"অনেক পাঠক আমাদের কাছেও বলেছে যে তারা একটু নাটুকে ভঙ্গিতে গল্পগুলো শুনতে চায়। কিন্তু লেখক তার সাহিত্যে যে গল্পটা আঁকতে চেয়েছেন, আমরা কণ্ঠ দিয়ে সেই ছবিটাই আঁকতে চেয়েছি। আমরা কোনওভাবেই এটিকে শ্রুতিনাটক বা থিয়েটার বানিয়ে ফেলতে চাইনি," বলছিলেন মি. জুলকারনাইন।
"যখন আমাদের নাটকের প্রোডাকশন আসবে, তখন সেটা আমরা নাটকের মতো করেই করবো। অর্থাৎ, সচেতনভাবেই আমরা পার্ফরম্যান্সকে পরিমিত করছি। যাতে লেখককে প্রাধান্য দেয়া হয়। আবার কিছু প্রকাশক আমাদেরকে বলেছেন যে ওভার পারফর্ম্যান্স করলে আমরা বই দেবো না।"
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন