'আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি, তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি’- কবি সুফিয়া কামালের লেখা ‘আজিকার শিশু’ কবিতার এ চরণ দুটো মনে করিয়ে দেয়, শৈশবে ঘুড়ি ওড়ানোর সেই আনন্দময় স্মৃতির কথা। আগের সেই ঘুড়ি ওড়ানোর দিনগুলোতে গ্রামের শিশু, কিশোর ও যুবকরা ঘুড়ি, নাটাই বানানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তো।
ফাল্গুন থেকে বৈশাখ পর্যন্ত রোজ বিকেলে আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্য দেখা যেতো। তবে ঘুড়ি শুধুই যে ছোটরা ওড়াতো তা কিন্তু নয়, সকল বয়সীরা ঘুড়ি ওড়াতেন।। এখন সেই সময়টা দখল করে নিয়েছে প্রযুক্তি নির্ভর মোবাইল ফোন (স্মার্টফোন)। আগের সেই সময়গুলোতে গ্রামের বিভিন্ন এলাকা যুবকরা এখন মোবাইল ফোন নিয়ে সময় কাটাচ্ছে। কেউ কেউ সংসারের বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে।
উপজেলার গ্রামের বয়স্কদের কাছ থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি, বেতাগী সদর, হোসনাবাদ, মোকামিয়া, বুড়ামজুমদার, কাজিরাবাদ ও সড়িষামুড়ি ইউনিয়নগুলোর বাসন্ডা, পুলের হাট, ঝোপখালী, পুটিয়াখালী, ফুলতলা, দেশান্তরকাঠী, জলিশা, জোয়াড় করুণা, মাছুয়াখালী, বটতলা, বলইবুনিয়া, কুমড়াখালী, মায়ার হাট গ্রামগুলোর আকাশ ছেঁয়ে যায় নানা রঙের ঘুড়িতে। ডাকঘুড়ি, সাপঘুড়ি, মাছঘুড়ি, বায়ঘুড়ি, ফুলঘুড়ি, মানুষঘুড়ি ও তারাঘুড়িসহ বিচিত্র নাম এসব ঘুড়ির। আকাশ জুড়ে শোভা পাওয়া এসব ঘুড়ির বেশির ভাগই গ্রামীন তৈরি।
যে কেউ চাইলেই সহজে কিন্তু ঘুড়ি বানাতে ও ওড়াতে পারে না। সঠিক মাপ অনুযায়ী ঘুড়ি বানালে তা সহজেই উড়ে। ঘুড়ি তৈরিতে বাছাই করতে হয় বাঁশের ছাট। সেই ছাটের শলা দিয়ে ঘুড়ির ফ্রেম বানানো হয়। তার গায়ে কেউ পলিথিন, কেউবা রঙ বেরঙের কাগজ দেয়। এখানেও আছে হরেক বৈচিত্র্য। পলিথিনের ঘুড়ির ক্ষেত্রে তাতে দেয় নানান আকার। যেন দূর থেকে মনে হতে পারে, কোনো এক অচেনা পাখি আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। আবার কাগজের ঘুড়ি তৈরিতে অনেকেই ব্যবহার করে রঙিন কাগজ। কেউবা তাতে আবার যুক্ত করে বাহারি নকশা। ঘুড়ি তৈরি শেষে দৌঁড়ে যান ফাঁকা মাঠে হাতে তুলে নেন নাটাই-ঘুড়ি। ওই সময় ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতো। বিভিন্ন এলাকার লোকজন এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছুটে যেতো। যারা ভালো ঘুড়ি ওড়াতে বা বানাতে পারতো তাদেরকে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ভাড়া করে নিতো। এক সময় সুতো ছাড়তে ছাড়তে অনেকেই আনমনে ঘুড়ি হয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতো। শৈশবের এমনি হাজারো স্মৃতি মনে হলো।
ঘুড়ি বানানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের রিপন কুমার ঢালী জানায়, 'শৈশবে নিজ হাতে মনের মাধুরি দিয়ে বিভিন্ন ধরণের ঘুড়ি তৈরি করা হতো। এটি তৈরিতে বাঁশের শলা, সুতা ও রঙ্গিন কাগজ ব্যবহারসহ লাইটিং এর ব্যবস্থা করেছি। ঘুড়ি তৈরিতে খরচ হয়েছে মাত্র ১’শ ৫০ টাকা আবার কোনটা ২ 'শ ৫০ টাকা। ঘুড়ি ওড়াতে ভালোই লাগে।'
গ্রামে ঘুড়ির বিষয়ে সুধির হাওলাদার বলেন, প্লাস্টিক সারের বস্তা থেকে এক ধরনের পাতলা বুনন সুতো তুলে কিংবা বেত ও বাঁশের তৈরি পাতলা চ্যাটা আর একটি ছড়ের সঙ্গে বিশেষভাবে বেঁধে ঘুড়ির সঙ্গে সংযুক্ত করার পর আকাশে উড়িয়ে দিলে ঘুড়ি থেকে সুরেলা শব্দ শোনা যেতো। এই ঘুড়িকে ডাক ঘুড়ি বলা হতো। এই ঘুড়ির শব্দ এখন খুব কমই শোনা যায়।
বিকেলে গ্রামগুলোতে কেউ কেউ তাদের সন্তান নিয়েও আসতো ঘুড়ি উড়াতে। আবার অনেকেই বাপ-বেটার ঘুড়ি উড়ানো দেখতে হাজির হতে দেখা যেত। কিন্তু আধুনিক যুগে সেই ঘুড়ি ওড়ানো বিকেল গুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এ বিষয়ে মোকামিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান গাজী নফিছুর রহমান চুন্নু বলেন, 'প্রতিদিন বিকেলে ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার আকাশে দিকে তাকালে দেখা যায়, নানা রঙ, নানা ঢংয়ের ঘুড়ি উড়ছে। ঘুড়িগুলো যেন বাতাসের সঙ্গে খেলায় মেতেছে।'
তবে এ উপজেলায় গ্রামগুলোতে এখনো মাঝে মাঝে দু' চারজনকে ঘুড়ি উড়াতে দেখা যায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন