বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যম, গণতন্ত্র বা শান্তির জন্য এখন বড় হুমকি ভুয়া খবর। ভুয়া খবর কখনো ছড়িয়ে দেয়া হয় পরিকল্পিতভাবে আবার কখনো অসচেতনতার অভাবে ভাইরাল হয়ে যায়। সমাজে বা দেশে যার প্রভাব ভয়াবহ।
বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ছড়ানো ভুয়া খবরের জালে পা দিয়ে বিপদ ডেকে আনেন অনেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচনের আগে রাশিয়া কর্তৃক ভুয়া খবর ছড়ানোর পর বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারে বিশ্ব। এরপরই নড়েচড়ে বসে উন্নত দেশগুলো। ভুয়া খবর প্রতিরোধে অনেক দেশকে সাইবার যুদ্ধ করতে হচ্ছে।
বর্তমান দুনিয়ায় তথ্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ তালিকায় রয়েছে ফিনল্যান্ড। দেশটির আয়তন বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় তিনগুণ। কিন্তু জনসংখ্যা মাত্র ৫২ লাখ। ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারে তাদের নজরদারী মামুলি ব্যাপার।
কিন্তু দেশটি নজরদারী বা নিয়ন্ত্রণ পন্থার চেয়ে সচেতনতাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। সাইবার যুদ্ধের পরিবর্তে তারা বেছে নিয়েছে সামাজিক যুদ্ধ। দেশের তরুণ প্রজন্মকে এ বিষয়ে সচেতন করতে স্কুলে স্কুলে কাউন্সেলিং বা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে দেশটি। ফলে ভুয়া খবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কার্যত দেশটি জয়ে পথে।
ফিনল্যান্ডে ভুয়া খবর মোকাবেলায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কিভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন। ‘ভুয়া খবরে বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের পথে ফিনল্যান্ড’ শিরোনামের প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীদের সচেতনতার মাধ্যমে কিভাবে ভুয়া খবর মোকাবেলা করা যায় তার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদক এলিজা ম্যাকিনতস ও ভিডিও প্রতিবেদক এডওয়ার্ড কিয়েরনার ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি থেকে সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় হেলসিংকিতে কিছু তরুণকে একত্রিত হতে দেখা যায়। যারা বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। তারা একটি বক্তব্য শোনার জন্য একত্রিত হয়। বক্তব্যটি ছিল ভুয়া খবর মোকাবেলার ওপর। তবে এ বিষয়টি ওই শিক্ষার্থীদের কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
‘আপনি কি রাশিয়ার সাইবার সেনাদের দ্বারা আক্রান্ত’ এমন শিরোনামে একটি পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন করা হয় সেই বক্তব্যে। সেখানে শিক্ষার্থীদের দেখানো হয় কোন কোন উপায়ে, কিভাবে সামাজিকমাধ্যমে ব্যবহৃত সফটওয়্যার দিয়ে ব্যবহারকারীর ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের (মোবাইল, ল্যাপটপ ইত্যাদি) তথ্য চুরি করা হয়। এটির সঙ্গে কিভাবে ভুয়া ভিডিও ও ছবি বানানো হয় এবং সেগুলো কিভাবে শনাক্ত করতে হয় তা দেখা হয়।
রাশিয়া থেকে প্রায় ১০১ বছর আগে স্বাধীনতা অর্জন করে ফিনল্যান্ড। কিন্তু ২০১৪ সালে রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়ায় হস্তক্ষেপ এবং ইউক্রেনে দেশটির সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব পড়ে ফিনল্যান্ডের ওপর। ফলে রুশ সাইবার সেনাদের মোকাবেলায় দেশের তরুণদের মাঝে এই সচেতনতা সৃষ্টি শুরু করে সরকার।
ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রধান টেলিকমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ তৈভেনান বলেন, ভুয়া খবর ছড়াতে সাইবার দুনিয়ায় রাশিয়া কতটা অভিযান করেছে তার সঠিক সংখ্যা বলা সম্ভব নয়। তবে বেশিরভাগ অভিযানই হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোকে ঘিরে। কারণ ফিনল্যান্ড ন্যাটোর পূর্ণ সদস্য, যা রাশিয়ার জন্য হতাশাজনক।
ফিনল্যান্ডকে ঘিরে রাশিয়ার ভুয়া খবর ছড়ানোর বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে প্রথম সাইবার যুদ্ধ ঘোষণা করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী সুলি নিনিস্তো। তিনি ফিনল্যান্ডের নাগরিকদের এ বিষয়ে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব নেয়ার আহ্বান জানান।
এর এক বছর পর ফিনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের মোটা অংকের অর্থ দিয়ে হেলসিংকি নিয়ে যায়। তারা ইন্টারনেটভিত্তিক ভুয়া খবর প্রতিরোধে কৌশলপত্র তৈরি করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ফিনল্যান্ড এখনো তরুণ ও শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ অব্যাহত রেখেছে।
এসব পদক্ষেপের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে ভুয়া খবর প্রতিরোধের তালিকায় ফিনল্যান্ড এখন সবার উপরে। এই তালিকায় ফিন্যান্ডের পরে থাকা ১০টি দেশ যথাক্রমে; ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, এস্তোনিয়া, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি, আইসল্যান্ড, যুক্তরাজ্য এবং স্লোভেনিয়া।
ছোট্ট ভূখণ্ড হলেও ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বিশাল জনসংখ্যা নিয়ে এখন ভুয়া খবর বা গুজবের জ্বরে ভুগতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ভুয়া খবরের ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ইতিহাস বিকৃতি বা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার মতো ঘটনা দেখা গেছে। সামনের দিনে ভুয়া খবর আরও ভয়াবহ রুপ ধারণ করতে পারে; যা দেশের জন্য বড় শঙ্কার কারণ। কিন্তু ফিনল্যান্ডের মডেল অনুসরণ করে বিপুল সংখ্যক তরুণ আর শিক্ষার্থীদের ভুয়া খবর প্রতিরোধে কাজে লাগাতে পারলে বড় বিপর্যয় মোকাবেলা করা সম্ভব হতে পারে।
-সিএনএন অবলম্বনে লিখেছেন, সময় নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক পলাশ মাহমুদ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন