কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির ৭০তম জন্মদিন আজ। ১৯৫২ সালের এই দিনে ঢাকার নারিন্দায় জন্ম নেওয়া ফরীদি মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তুমুল খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৬৪ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে কিশোরগঞ্জের মহল্লার নাটক ‘এক কন্যার জনক’-এ প্রথম অভিনয় করেন ফরীদি। একসময় সবাই বুঝে ফেলেছিল ধূমকেতুর জন্ম হয়েছে। একদিন শাসন করবে এই যুবক। করেছেনও তাই। লিখেছেন- ফয়সাল আহমেদ
বাঙালির মধ্যবিত্ত সামাজিক জীবনধারাকে তিনি আনন্দিত করে তুলেছিলেন। ফরীদির নাটক মানেই টিভির পর্দায় পুরো বাঙালির চোখ আটকে যাওয়া। হতাশ করতেন না তিনি। এত প্রাণবন্ত, এত জীবন্ত, যেন আমাদের চারপাশের মানুষগুলোই জীবন্ত হয়ে যেত তার অভিনয়ে। মঞ্চ দিয়ে যাত্রা করা ফরীদি টিভি নাটক দিয়েই দর্শকের কাছে জনপ্রিয়তা পান। হয়ে উঠেছিলেন তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা। সেই তিনিই চলচ্চিত্রে এসে হৈচৈ ফেলে দিলেন। মন্দ-ভালো নানা চরিত্রে তার বৈচিত্র্যময় অভিনয় হাসিয়েছে দর্শককে, কাঁদিয়েছে, ভয়ও ধরিয়েছে। তার ক্যারিয়ারে অনেক কালজয়ী চরিত্র ও সংলাপ উপহার দিয়েছেন। আবার মসলাদার কিছু বাণিজ্যিক সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন যা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। সেই কাজগুলোকে ফরীদিও এড়িয়ে যেতে চাইতেন। মনে করতেন এগুলো তার রুটি রুজির প্রয়োজনেই করা। শিল্প এখানে না খোঁজাই উত্তম।
বাণিজ্যিক ধারার সামাজিক অ্যাকশন ছবির জমজমাট ’৮০র দশক পার হয়ে শুরু হলো ’৯০ দশক। সেই ’৯০ দশকের শুরুতেই বাংলা চলচ্চিত্রে আবির্ভাব হয় ফরীদি নামক জনপ্রিয় একজন টেলিভিশন নাট্যাভিনেতার। যিনি মাত্রই শেষ করে এসেছেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক শহীদুল্লা কায়সার রচিত ও আবদুুল্লাহ আল মামুনের নাট্যরূপ ‘সংশপ্তক’। যে নাটকে ফরীদি ছিলেন মিয়া বাড়ির প্রধান মিয়ার বেটার (খলিলুল্লাহ খান) ঘনিষ্ঠ সহচর, খাস লোক বা বিশ্বস্ত ‘হুকুমের গোলাম’ রমজান। যিনি পরবর্তীকালে গ্রামের হুরমতি নামক এক অসহায় দরিদ্র নারীর ওপর লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে থাকেন। যার ফলে হুরমতি প্রতিশোধ নিতে রমজানের ডান কান কেটে ফেলে। রমজান হয়ে যায় ‘কান কাটা রমজান’। সেই ‘কান কাটা রমজান’ এতটাই জনপ্রিয় ও আলোচিত হয় যে টিভি নাটকের ব্যস্ত ফরীদির বাংলা চলচ্চিত্রে সুযোগ আসে খল চরিত্রে অভিনয় করার।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ধারার ছায়াছবির জনপ্রিয় ও ব্যস্ত পরিচালক শহিদুল ইসলাম খোকন বরাবরের মতো চিত্রনায়ক রুবেলকে নিয়ে ‘সন্ত্রাস’ ছবিটি নির্মাণ শুরু করতে যাবেন। ছবির শুটিং শুরু করার আগে পরিচালকের মাথায় হঠাৎ খেয়াল চাপে জনপ্রিয় ‘কান কাটা রমজান’ অর্থাৎ হুমায়ুন ফরীদিকে ছবির প্রধান খলনায়ক হিসেবে নেবেন। কিন্তু ফরীদির চলচ্চিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা এর আগে মাত্র একটি তাও মূলধারার বাইরে। যার নাম ছিল ‘দহন’। ফরীদিকে খলনায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রের দর্শক কীভাবে নেবে সেটাও ছিল চিন্তার বিষয়। কারণ তখন চলচ্চিত্রে খলনায়ক হিসেবে রাজীব, এটিএম শামসুজ্জামান, আহমেদ শরীফ, খলিলুল্লাহ খান, মিজু আহমেদ, রাজ, মাহবুব খান, ড্যানি সিডাক দারুণ ব্যস্ত এবং সফল। এমতাবস্থায় জনপ্রিয় খলনায়কদের ছাড়া রুবেলের মতো মার্শাল আর্ট হিরোর ছবিতে টেলিভিশনের একজন অভিনেতাকে নির্বাচন করাটাও বিরাট ঝুঁকি। তার পরও পরিচালক আলপনা চলচ্চিত্রের কর্ণধার প্রযোজক আজিজুল হক পুটুর সঙ্গে একরকম চ্যালেঞ্জ নিয়েই ফরীদিকে ছবিতে খলনায়ক হিসেবে নির্বাচন করেন। ‘কান কাটা রমজান’-এর রেশটা তখনো দর্শকদের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল। মুক্তি পেল ছবিটি। প্রথম দিনেই দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়। হল থেকে বের হওয়ার পর দর্শকদের মুখে মুখে শুধুই ‘ফরীদি, ফরীদি’ সেøাগান। এর পর ফরীদিকে দেখা গেছে বহুরূপে। সব রূপেই ফরীদি দারুণ ছিলেন। ‘টপ রংবাজ’ ছবির ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলা ফরীদি আবার মুগ্ধ করলেন। শিবলী সাদিক পরিচালিত ‘ত্যাগ’ ছবিতে ‘তেল গেলে ফুরাইয়া বাত্তি যায় নিভিয়া’ গানটি হিট। গানটিতে পর্দায় ঠোঁট মিলিয়েছিলেন ফরীদি। ‘ত্যাগ’ ছবিতেও ফরীদি ভয়ঙ্কর এক খুনি। ছবির ‘লাগছে, লাগছে, জায়গা মতো লাগছে’ সংলাপটি হিট। ‘লাভ’ ছবিতে রাজিবের সঙ্গে দুর্দান্ত রসায়ন আর সংলাপ ‘ডান্ডি পটাশ’ হিট। অর্থাৎ ফরীদি বারবার এসে পর্দা কাঁপিয়েছেন। শহিদুল ইসলাম খোকনের ‘অপহরণ’ ছবিটির ছেলেধরা ফরীদিকে আজও মনে পড়ে। ছবিটিতে ফরীদি ছিলেন খলনায়ক কিন্তু পুরো ছবিতে দর্শক হাসতে হাসতে শেষ। হাফিজউদ্দিন পরিচালিত ‘টাকার অহংকার’ ছবিটিতে ফরীদি অসাধারণ। খলনায়ক না ভালো মানুষ সেটা নিয়ে দর্শক দ্বিধায় পড়ে গেল। এ ছাড়া বিশ্বপ্রেমিক, কমান্ডার, ঘাতক, ঘৃণা, পালাবে কোথায়, রাক্ষস, মাতৃত্ব, লম্পট, ঘরের শত্রু, শত্রু ভয়ঙ্কর, অনুতপ্ত, গৃহযুদ্ধ, ঘাত প্রতিঘাত, সংসারের সুখ দুঃখ, বাপের টাকা, অধিকার চাই, অনেক দিনের আশা, মানুষ, ডন, মহাগুরু, ম্যাডাম ফুলি, পাগলা ঘণ্টা, হিংসা, স্ত্রী হত্যা, ভণ্ড, প্রেম দিওয়ানাসহ অসংখ্য ছবির ফরীদি উজ্জ্বল। হুমায়ুন ফরীদির রক্তে মিশে ছিল অভিনয়। টানা তিন দশক তার ক্যারিশম্যাটিক, তার ম্যাজিক্যাল অভিনয়ে বুঁদ করে রেখেছিলেন পুরো জাতিকে।
হুমায়ুন ফরিদীর রক্তে মিশে ছিলো অভিনয়। টানা তিন দশক তার ক্যারিশম্যাটিক, তার ম্যাজিকাল অভিনয়ে বুঁদ করে রেখেছিলেন পুরো জাতিকে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন