লীনা পারভীন
এত এত সাফল্যের মাঝেও কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে আমাদের। কেন? সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বি আই ডি এস) একটি জরিপে উঠে এসেছে যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনও অন্য কোনও বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে এখন মোট শিক্ষার্থী আছেন ২০ লাখের মতো। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাইরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের উচ্চশিক্ষায় একটি বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। অথচ বৃহত্তর এই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত আজ প্রশ্নের সম্মুখীন।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ ভাগ হচ্ছে তরুণ সমাজ এবং প্রাকৃতিক নিয়মে বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধার আওতায় আছে। কিন্তু আমরা কি সেইসব তারুণ্যের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারছি? বলা হয়, এই সুবিধা মাত্র ৩০ বছর বাস্তব থাকে অর্থাৎ এরপর আবারও জনগোষ্ঠীতে বয়সসীমা পাল্টাতে থাকে যেখানে কর্মক্ষম জনগণের চেয়ে নির্ভরশীল জনগণের মাথা থাকে বেশি।
বিআইডিএস একটি অত্যন্ত সুপরিচিত ও গবেষণার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান। তাই তাদের এই জরিপের উপর সন্দেহ করা যায় না। পরিসংখ্যানের বাইরেও আমরা যদি আমাদের বাস্তব বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও বিচার করি তাহলেও কিন্তু চিত্রটা খুব সুখকর নয়। আমাদের আশেপাশে কর্মক্ষম প্রচুর মানুষ আছেন যারা কেবল একটি কাজের সুযোগ খুঁজছেন। এইচআর এ কাজ করার ফলে এমন প্রচুর বেকারের কথা আমার জানা আছে, যারা একটি চাকরির জন্য রীতিমত চোখের পানি ফেলছে। প্রতিদিন গড়ে দুই তিনটা অনুরোধ পাই। পছন্দ বা কাজের ধরণ নির্বাচনতো দূরের কথা, তারা কেবল খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য একটি কাজের সন্ধান চান। করোনাকালে এর সংখ্যা বেড়েছে ভয়াবহ আকারে।
আমরা জানি, বর্তমান সরকারের অনেক রকম পরিকল্পনা আছে তরুণ ও কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে। কিন্তু সেসবের ফলাফল পাওয়া যাবে আর কবে? একদিকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ চাকরি পাচ্ছেন, অন্যদিকে সঠিক দক্ষতার লোকের অভাবে চাকরি দেয়া যাচ্ছে না বলেও বলে থাকেন আমাদের চাকরিদাতারা। এই যে চাহিদা ও যোগানের অসামঞ্জস্যতা, এর কারণ কি আমরা ভেবে দেখেছি কখনও? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও চলছে শতবছরের পুরনো কাঠামোতেই। এর আধুনিকায়ন বা যুগের চাহিদা অনুযায়ী যে পরিবর্তন বা পরিমার্জনের প্রয়োজনীয়তা ছিল, সেই কাজটি করার কথা চিন্তাই করেনি কেউ। বছরের পর বছর কেবল কিছু সার্টিফিকেটধারীর জন্ম দিচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। সেখানে বাস্তবতার নেই কোন সংমিশ্রণ।
আমাদের চাকরির বাজারটিও কি খুব পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে? তা হয়নি। বর্তমানে সবচেয়ে আকর্ষণীয় চাকরির খাত হচ্ছে সরকারি চাকরি। কেন? কারণ এই খাতে বেতন বেড়েছে প্রায় শতগুণ, আছে প্রশাসনিক ক্ষমতা ও মর্যাদা। সবচেয়ে বড় কথা সেখানে আছে চাকরির স্থায়ী নিশ্চয়তা যার কোনটাই নেই বেসরকারি খাতে। বেসরকারি খাতের মধ্যেও হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বাইরে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই নেই কোন নিয়ম কানুনের বালাই। যোগ্যতার বিচারই বা হচ্ছে কীভাবে? নতুন উদ্যোক্তা তৈরির জায়গাটি নিয়ে চলছে চরম দুর্নীতি। অনিয়ন্ত্রিত এই খাতটিকে ব্যবহার করে এক শ্রেণির লুটেরার জন্ম নিয়েছে। যে কারণে এরই মধ্যে সম্ভাবনাময় এই খাতটি এখন আতংকের আরেক নাম।
বাস্তবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে পুরোটাই। যুগোপযোগী বা যুগের চাহিদা মাফিক যদি শিক্ষাক্রমকে সাজাতে না পারি তাহলে বেকারের সংখ্যা বাড়তে খুব বেশিদিন লাগবে না। এখানে খুব বেশি কাজের কিন্তু দরকার নেই। কেবল দরকার চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষাখাতের একটি সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন। অর্থাৎ যেসব সেক্টর ক্রিয়াশীল আছে সেখানে কোনো ধরণের যোগ্যতা বা দক্ষতার প্রয়োজন আছে, সেগুলোকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি বাস্তব জ্ঞানের প্রতিও উৎসাহী করে তুলতে হবে। একদিকে কর্মক্ষেত্রের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নতুন নতুন বিনিয়োগের সুযোগ ও সুবিধা তৈরি করা আর অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সক্রিয় মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে সিলেবাস সাজানো।
চাকরির ইন্টারভিউ নিতে গেলে দেখা যায়, প্রার্থীরা খুব সাধারণ কিছু দক্ষতা সম্পর্কেও জানে না। এখন তথ্য প্রযুক্তির যুগ। আগেরদিনের মত খাতা-কলমের হিসাবের দিন আর নাই। তাই কম্পিউটার জ্ঞান এখন একদম বেসিক বা প্রাথমিক পর্যায়ের জ্ঞানে পরিণত হয়েছে। কেবল বইপড়া জ্ঞান দিয়ে আর এ যুগে তাল মিলানো যাবে না। প্রতিযোগিতার বিশ্বে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে একজন যোদ্ধা হিসেবে। চাকরির বাজার একটি যুদ্ধক্ষেত্রে আর নিজেকে একজন সফল যোদ্ধা হিসেবে দেখতে চাইলে জানতে হবে যুদ্ধে লড়ার কৌশলগুলো কী কী? এই জ্ঞান কেবল ছাত্রদের থাকলেই চলবে না। থাকতে হবে শিক্ষকদেরও। কারণ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদেরকে এই জ্ঞানগুলো দিবেন কিন্তু আমাদের শিক্ষকরাই। এর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলেই কর্পোরেট জগতের অভিজ্ঞ লিডারদের নিয়েও কিন্তু এই জ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটাতে পারেন।
আসলে ভাবতে হবে আমাদেরকে। অনেক উপায়েই কিন্তু সমস্যার সমাধান করা যায়। উন্নত দেশ হতে গেলে আমাদেরকে অবশ্যই শিক্ষা ও কর্মসংস্থান এই দুটি জায়গা নিয়ে অনেক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের পথে হাঁটতে হবে। বেকারত্বের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্থায়ী হবে না। নির্ভরশীল বা অদক্ষ মানবসম্পদ যে কোন জাতির জন্য বোঝা। উন্নত দেশের পথে হাঁটতে হলে আমাদের এই বোঝা কমাতেই হবে। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত দিয়ে কিচ্ছু হবে না। দরকার প্রকৃত দক্ষতায় শিক্ষিত মানুষ।
লেখক: কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন