বিটিভির সাদাকালো সময়ে নির্মিত অধিকাংশ নাটকই ছিল দারুণ জনপ্রিয়। সে সময় ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশনে দর্শকরা আবদুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ আহসান আলী সিডনী, গোলাম মুস্তাফা, আফজাল হোসেন, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফেরদৌসী মজুমদার, আলী যাকের, রামেন্দু মজুমদার, সারা যাকের, দিলশাদ খানম, আসাদুজ্জামান নূর, কেয়া চৌধুরী, প্রিসিলা পারভীন, রিনি রেজা, শম্পা রেজা, মিতা চৌধুরী, সুবর্ণা মুস্তাফা, নীপা রেজা, নায়লা আজাদ নূপুরের কেমিস্ট্রি দেখতে একমনে বসে থাকত।
মিতা চৌধুরী-আসাদুজ্জামান নূর, আফজাল-সুবর্ণা জুটির ক্রেজ তখন তুঙ্গে। রোমান্টিক জুটি হিসেবে সার্থক। হুমায়ুন ফরীদি-সুবর্ণা, রাইসুল ইসলাম আসাদ-সুবর্ণাও বেশ নাম করেছিলেন। নাটকের স্ক্রিপ্ট ছিল খুবই শক্তিশালী, অভিনয় ছিল মানসম্মত। নাটক তৈরি হতো কম কিন্তু হতো মনে রাখার মতো। একটা ঘণ্টা মনেই হয় না যেন কোনো নাটক দেখছি। মনে হয় যেন নিজের জীবনে নিজেদের পরিবারে এই ঘটনাপ্রবাহ ঘটে চলেছে। নাটক শেষ হলেও মনে তার রেশ রয়ে যেত। উত্তরসূরিদের পথ ধরে একসময় অভিনয়ে এসেছেন জাহিদ হাসান, শহীদুজ্জামান সেলিম, বিপাশা হায়াত, রোজী সিদ্দিকী, তৌকীর আহমেদ, শমী কায়সার, আফসানা মিমি, আজিজুল হাকিম, মাহফুজ আহমেদ, তানিয়া আহমেদের মতো জনপ্রিয় সব তারকা। এখনো তাদের নিয়ে দর্শকের মাঝে অন্যরকম আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাদের পরবর্তীতে অনেক অভিনয়শিল্পীই মিডিয়ায় এসেছেন। কাজ করেছেন এবং করছেন। কিন্তু এসব শিল্পীকে নিয়ে দর্শকদের মাঝে আগ্রহ খুবই কম। নবীন শিল্পীদের নিয়ে নির্মাতারা বহু নাটক নির্মাণ করলেও দর্শক তাদের ঠিকভাবে চেনেন না। সর্বশেষ নুসরাত ইমরোজ তিশা-সজল জুটিকে দর্শক একটু হলেও চেনেন! এত এত শিল্পী কাজ করলেও ড্রইং রুম মিডিয়ায় শিল্পী সংকট রয়েছে বলেই মনে করছেন অনেকে। অন্যদিকে এই সময়ে ঘুরেফিরে একই মুখ ও দুই-তিনজনের জুটি টিভি নাটক ইন্ডাস্ট্রিকে করেছে বাক্সবন্দী। গত এক দশকে খ-নাটকের চাহিদা বেড়েছে। তাই দর্শকের আগ্রহকে পুঁজি করে বেশিরভাগ নির্মাতা-অভিনয়শিল্পী সিন্ডিকেট করে কাজ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এটা আগামীতেও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে আভাস রয়েছে। কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী একে অন্যের সঙ্গে জুটি গড়ে করছেন নাটক। এসব অভিনয়শিল্পীর বাইরে আর কোনো শিল্পী তেমন করে কাজ করতে পারছেন না। সাধারণ দর্শক বারবার একই মুখ ও জুটি দেখতে দেখতে বিরক্ত। তবুও নির্মাতা-প্রযোজক-অভিনয়শিল্পী ও টিভি চ্যানেল মালিকদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই এই বিষয়ে। জানা যায়, ঈদ বা বিশেষ দিবসের আগে এই সিন্ডিকেট বেশি চোখে পড়ে। সিন্ডিকেটের কারণে চাহিদাসম্পন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নির্দিষ্ট পরিচালকের বাইরে গিয়ে কাজ করতে চান না। সিন্ডিকেটের বাইরে কাজের প্রস্তাব এলে নির্মাতাদের ফিরিয়ে দেন শিডিউল নেই বলে। ফলে বছরজুড়ে টিভি পর্দায় ঘুরেফিরে দেখা যায় একই নিশো-মেহজাবিন, অপূর্ব-তানজিন তিশা বা নিশো-তানজিন তিশা, অপূর্ব-মেহজাবিন জুটি। এই চার অভিনয়শিল্পীকেই একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় নাটকে। এই জুটির কেউ কেউ আবার ঈদে ৪০টির বেশি নাটকে কাজ করেছেন। এতে করে তাদের সমসাময়িক অনেক তারকারই কাজ কমে গেছে। এই সময়ে জুটি বেঁধে কাজ করতে দেখা যায় জোভান-তাসনুভা তিশা বা জোভানের সঙ্গে নাদিয়া খানম ও প্রভাকে, তৌসিফ মাহবুব-সাফা কবির বা তৌসিফ-সাবিলা, ইরফান সাজ্জাদ-শবনম ফারিয়া বা ইরফানের সঙ্গে তানজিন তিশা, সাবিলা, ফারিন, টয়া, সাফা চৌধুরীকে। এই ধারার মধ্যেও নিজেদের মতো করে কাজ করে চলেছেন জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, নুসরাত ইমরোজ তিশা, মম, জুঁই করিম, শাহানাজ খুশি, রুনা খান, নাদিয়া আহমেদ, তাহসান, সজল, এফ এস নাঈম, জাকিয়া বারী মম, অর্ষা, সারিকা, সায়লা সাবি প্রমুখ। ইদানীং শ্যামল মাওলা, মনিরা মিঠু, অপর্ণা, ঊর্মিলা, গোলাম কিবরিয়া তানভীর, সমাপ্তি মাশুক, জিয়াউল হক পলাশ, সারিকা সাবাহ, শাওন, নিলয়, নাবিলা ইসলাম, মিশু সাব্বির, আ খ ম হাসান, অহনা, অবাক, এম এন রাজু, শামীম হাসান সরকার, আইরিন আফরোজ, হিমি, পায়েল, মুশফিক ফারহান, অ্যানি খান, শহীদুল্লাহ সবুজ, বড়দা মিঠু, তামিম মৃধা, মায়মুনা মম, ইফফাত আরা তিথি, সুজাত শিমুল, ইভান সাইর, সানজিদা ইসলাম নিজেদের মতো নাটকে কাজ করছেন। নাটকের বর্তমান অবস্থা নিয়ে চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘ভিউ বাণিজ্যের এই যুগে সুস্থ-সুন্দর ভালো নাটকগুলো সাইড হয়ে যাচ্ছে। যারা টিভি নাটকের ব্যবসাটা করেন, তাদের হাতে গোনা কয়েকজন আর্টিস্ট-ডিরেক্টর আছেন যারা তাদের নাটকই প্রমোট করেন। সেসবের মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয়। টিভি নাটকের যে সুস্থ-সুন্দর একটা গতি ছিল, সেটা এই সিন্ডিকেট বন্ধ করে দিচ্ছে।’ এদিকে হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পীকে ঘিরে কাজ করার কারণে নাটকের বৈচিত্র্যতা যেমন হারাচ্ছে, তেমনি বিরক্ত হচ্ছেন দর্শকও। ভালো গল্পের অভাব, অভিনয়শিল্পী পছন্দের ক্ষেত্রে লগ্নিকারীদের বাধ্যবাধকতা, প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পরিমাণে নাটক নির্মাণ সংকটের অন্যতম কারণ। গত কয়েক ঈদেও ঘুরেফিরে কয়েকজন অভিনয়শিল্পীকেই টেলিভিশন, ইউটিউব, ডিজিটাল প্লাটফর্ম সবক্ষেত্রেই দেখা গেছে। এখন তো অভিনয়শিল্পীর প্রয়োজনে গল্প নিয়ে নাটক নির্মিত হচ্ছে। কিছু অভিনয়শিল্পী গল্পও দিয়ে থাকেন। নির্মাণের কাজেও হাত ঢুকিয়ে দেন। ফলে তাদের খবরদারিতে নাটকের মান খারাপ হয়। এখন তো ইউটিউব প্লাটফর্ম বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতি সবার আগ্রহ কমে গেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন