ড. আহমেদ আদম; অনুবাদঃ রাফে সালমান রিফাত
পিতামাতার ভূমিকা
আমাদের সন্তানেরা প্রতিনিয়ত টেলিভিশন, মুভি, ভিডিও, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, বই এবং বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে যৌনতার অপলাপ সম্পর্কে জানতে পারছে। তাদের তরুণ হৃদয় এমন মগজধোলাই এর স্বীকার হচ্ছে যে, নৈতিকতা, শালীনতা এবং মূল্যবোধের মতো বিষয়গুলো যেন পুরানো হয়ে গেছে। যদি আমরা আমাদের সন্তানদের সামনে জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলোর প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে না পারি এবং তাদেরকে সাংস্কৃতিক ও সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ- ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নৈতিক আচরণগুলো কী তা না জানাতে পারি এবং এর ফলে যদি তারা যৌনতা, নেশা, কৈশোরে গর্ভধারণ, পতিতাবৃত্তি, মাদক ও জুয়ার মতো পঙ্কিলতার ফাঁদে আটকে যায় তবে আমাদেরকেও সমানভাবে দায়ী থাকতে হবে। আমাদের করণীয় হতে পারে নিম্নরূপঃ
প্রাক কৈশোরপ্রাপ্ত কন্যার প্রতি উপদেশ
হে কন্যা, তোমাকে এখন বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে যা শীঘ্রই তোমাকে করে তুলবে একজন পরিপূর্ণ নারী। এই পরিবর্তনের সাথে সাথে তোমার উপর এক বিশাল দায়িত্ববোধ সৃষ্টি হবে। তা হলো- তুমি একদিন মা হবে।
তোমার শরীরের এই পরিবর্তনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠবে তোমার স্তনের আকার, চেহারা, উচ্চতা, ওজন। প্রতিমাসে নিয়মিত প্রবাহে ঋতুস্রাবের সূত্রপাত হবে। তবে এর মধ্যে ভয়ের কিছু নেই। বরং এটা মহান আল্লাহর এক অলৌকিকতা যার মাধ্যমে একজন নারীর গর্ভ ডিম্বাণু ধারণ করে দিনে দিনে প্রস্তুত হয়ে ওঠে নিষেকের জন্য।
কয়েক দশক আগের চেয়েও এই প্রজন্মে এই পরিবর্তনগুলো আরো দ্রুত চলে আসছে। শিশুরা আমাদের কল্পনার চেয়ে দ্রুততর সময়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে। আগের প্রজন্মগুলোতে দেখা যেতো যে, একজন কিশোরীর সচরাচর ১৩ বছর বয়সে ঋতুস্রাব শুরু হতো। কিন্তু বর্তমানে ৯ বছরের বালিকার ঋতুস্রাব শুরু হতে দেখা যাচ্ছে। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, তুমি যদি এই বয়সে যৌন মিলনে অংশ নাও তবে তুমিও গর্ভবতী হয়ে যেতে পারো। আর তুমি যদি এই বয়সে গর্ভবতী হয়ে পড়ো তবে তোমার সমগ্র জীবনের গতি প্রকৃতিই পালটে যাবে, ধ্বংসের মুখে উপনীত হবে তুমি। তোমার জীবনের যতো স্বপ্ন, লক্ষ্য, ইচ্ছা -আকাঙ্ক্ষা আছে সবকিছুই নষ্ট হয়ে যাবে বা চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
নিজের শরীর নিয়ে অবশ্যই সুখী থাকবে। তোমার শরীরে হরমোন সংক্রান্ত বিভিন্ন পরিবর্তন আসবে। যা তোমার আবেগ অনুভূতির পরিবর্তনে প্রভাব ফেলবে। তোমার মুড ওঠানামা করবে এবং এমনকি তোমার মুখে ব্রণ উঠতে পারে। এই সময়টা সবার সাথে মনোমালিন্যের সময়। পিতামাতাকে এ সময় সংযত থাকতে হয় এবং সন্তানের সাথে বিষয় গুলো ভালোবাসা এবং মমতার উপলব্ধি নিয়ে আলোচনা করতে হয়। এসময় তোমার জন্য সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকার বিষয় হচ্ছে বন্ধুদের চাপ থেকে সতর্ক থাকা, যা তোমাকে উৎসাহিত করবে চুম্বন, যৌনমিলন ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষামূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হতে।
কিছু কিশোর তোমার দিকে ক্ষতিকর দৃষ্টি প্রদান বা মন্তব্য ছুড়ে দিতে পারে এবং তুমি যদি প্ররোচিত না হও তবে তোমার মধ্যে একাকীত্বের অনুভূতি এনে দিতে পারে। তাদের কথা শুনবে না। তোমার নিজের মধ্যে অবশ্যই এই আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে যে, তুমি মহান আল্লাহর আদেশ মেনে চলছো। এবং এ ধরণের ক্ষেত্রে তোমার খুব সহজ কথায় বলে দেয়া উচিত, "না, আমি আগ্রহী নই।" এটা তোমার জন্য এমন এক সিদ্ধান্ত হবে যা নিয়ে তুমি কখনই পরিতাপ করবে না।
বিশেষ করে বয়স্ক ছেলে এবং লোকদের এড়িয়ে চলবে। তারা তোমাকে উপহার দিবে, ফুল দিবে, মিথ্যা ভালোবাসার প্ররোচনা দেখাবে। কিন্তু আসলে তারা যেটা করছে তা হলো তোমাকে বিছানায় নেয়ার একটা ফাঁদ পাতা যাতে তুমি তোমার কুমারীত্ব হারাও। তারপর তারা তোমাকে পরিত্যাগ করবে এবং পরবর্তী সরলমনা বালিকার কাছে যাবে। এই প্রক্রিয়ায় তুমি তোমার ব্যক্তিসত্তার কয়েকটি জিনিস হারাবে।
- তুমি তোমার কুমারীত্ব হারাবে।
- তুমি কুরআনের সেই আয়াতকে লংঘন করবে যাতে তোমাকে যিনা না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
- তুমি অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের সম্মুখীন হতে পারো (অনেক মেয়েই এখনও এই মিথ্যা শ্রুতিকথায় বিশ্বাস করে যে প্রথম যৌনমিলনে তারা গর্ভবতী হবে না।)
- তুমি এইচআইভি/এইডস সহ যেকোন যৌনরোগে আক্রান্ত হতে পারো। কিছু যৌনরোগের কোনো প্রতিকার নেই। যেমন- হার্পিস এবং যৌনাঙ্গের আচিল। কিছু যৌনরোগের যদি পরিপূর্ণ চিকিৎসা না করা হয় তবে তা বন্ধ্যাত্ব এনে দিতে পারে। এবং এর ফলে তুমি সন্তান নিতে আর সক্ষম হবে না। অথবা সেগুলো তোমাকে জরায়ুমুখ ক্যান্সার এনে দিতে পারে।
প্রাক কৈশোর প্রাপ্ত পুত্রের প্রতি উপদেশ
হে পুত্র, তুমি বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছো যা তোমাকে যৌবনে পদার্পণের জন্য প্রস্তুত করছে যাতে তুমি একদিন বাবা হতে পারো। তুমি তোমার কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন লক্ষ করবে। তোমার মুখে ব্রণ হতে পারে। এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে লোম গজাতে পারে। ঘন ঘন মুড পরিবর্তন থেকে শুরু করে স্বপ্নদোষ, বীর্যপাত ইত্যাদি খুব সাধারণ ঘটনা এসময়।
তোমার শরীরের স্বাভাবিক ঘামের গন্ধ বৃদ্ধি পাবে, সুতরাং তোমার উচিত নিয়মিত গোসল করা এবং শারীরিক পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ নজর দেয়া।
হুট করেই তোমার শরীর দ্রুত বেড়ে উঠবে। এবং এ সময় তোমার বেশি করে খাওয়াদাওয়া করা প্রয়োজন, শারীরিক অনুশীলন প্রয়োজন এবং পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন যাতে বাড়ন্ত শরীরের সর্বোচ্চ উপকার তুমি পেতে পারো।
তোমার বন্ধুরা তোমাকে কোনো মেয়ের সাথে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করবে৷ কুরআন এবং রাসূলের সুন্নাহর বিধান অনুসারে একজন মুক্ত চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে তোমাকে অবশ্যই নিজের সক্ষমতার উপর আত্মবিশ্বাস থাকা উচিত। সমস্ত নারীকে তোমার শ্রদ্ধা, মমতা এবং সৌজন্যতার দৃষ্টিতে দেখা উচিত। এমন দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয় যা ইচ্ছামত ব্যবহার করা যায়, অ্যাবিউজ করা যায় পণ্য হিসেবে।
টিভি, খবরের কাগজ এবং ম্যাগাজিনে তুমি দেখবে যে, এইচআইভি/এইডস থেকে মুক্তির জন্য কনডম ব্যবহার করা উচিত। মনে রেখো, এটা সেই শিক্ষা নয় যা ইসলাম আমাদেরকে শেখায়৷ ইসলাম বলে, নিরাপদ যৌনতা হলো, বিয়ের আগে যৌনমিলন নয়। তোমার মন, শরীর এবং আত্মাকে ইসলামের ছাঁচে তৈরী করার জন্য তোমার কর্মকে সেভাবে সাজাও৷ তোমার জীবনের অত্যন্ত চমৎকার সময় তুমি পার করছো, যেখানে তুমি বৃহত্তর দায়িত্ব থেকে মুক্ত। চেষ্টা করো নিজের সর্বোত্তম রূপে নিজেকে গড়ে তুলতে।
সারকথা
মহান আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। আমাদের সবাইকেই জীবনে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবুও, জীবন আমাদেরকে দিয়েছে অসীম চিন্তার এক ডালি এবং জটিলতা, যা আমাদেরকে মাঝে মাঝেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। কোনটি সঠিক সিদ্ধান্ত?
আমার কাকে সন্তুষ্ট করা উচিত?
কোনটি ফ্যাশনেবল?
আমার সিদ্ধান্ত কি আমাকে বিব্রত করবে?
একজন সিদ্ধান্তহীন ব্যক্তি সবসময় পরিস্থিতির স্বীকার হয়। ফ্যাশন ট্রেন্ড নির্ধারকদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়। প্রশান্তিতে থাকে সেইসব ব্যক্তি যারা কুরআন এবং সুন্নাহকে চলার পথের দিক নির্ণায়ক কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করে এবং সত্য থেকে মিথ্যার পৃথকীকরণে মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করে।
এই চমৎকার জগতে ভালো অনেক কিছুই আছে। তথাপি, এখানে কামনার অনেক কিছুও আছে৷ আমাদের এই আকাঙ্ক্ষা বা কামনা গুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে একেকটি পরীক্ষা৷ দিনশেষে, আমরাই সিদ্ধান্তগ্রহণকারী। আমরা শুধুমাত্র আমাদের জ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই একটি বুদ্ধিপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিতে পারি। বর্তমানে অনেক দেশের সরকারই এই প্রজন্মের মূল্যবোধকে পুনর্জাগরিত করার জন্য অতি দৃঢ়তার সাথে ভার্জিনিটির পলিসি গ্রহণ করছে; বিয়ের আগে যৌনমিলন নয়, ব্যভিচার নয় এবং অন্যান্য স্লোগানের মাধ্যমে।
ইসলামের সৌন্দর্য হচ্ছে, কুরআনে উল্লেখিত নির্দেশনা এবং গাইডলাইনসমূহ সার্বজনীন এবং একেবারে সর্বশেষ ট্রেন্ড এর উত্থানপতনের ক্ষেত্রেও তা প্রভাবমুক্ত। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং, তিনিই জানেন কোনটি আমাদের জন্য সর্বোত্তম। আমি আশা করি যে, এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা এই ব্যাপক বিস্তৃত টপিকের উপর একটু হলেও আলো ফেলেছে। আরও আশা করি, কিশোর এবং প্রাক কিশোরদের যে বর্তমান প্রজন্ম যারা প্রায়শই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় পড়ছে তারা তাদের সিদ্ধান্তের একটি পরিষ্কার ভিত্তি এই আলোচনার মাধ্যমে পাবে।
সর্বশেষ, প্রাক কিশোরদের এক নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠছে। একটি সম্প্রদায় এবং জাতি হিসেবে তরুণদের সামনে পরিষ্কার গাইডলাইন দেয়াটা আমাদের সামষ্টিক দায়িত্ব। আমাদের তরুণরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। সকল প্রশংসার যোগ্য, পরম করুণাময়, মহান আল্লাহ আমাদের এবং আমাদের তরুণদেরকে তার প্রজ্ঞা এবং ক্ষমার অবারিত ভান্ডার থেকে সরল সঠিক পথের দিশা দান করুন। আমীন।
উৎস
প্রথম পর্বঃ এখানে ক্লিক করুনclick here
দ্বিতীয় পর্বঃ এখানে ক্লিক করুন click here
তৃতীয় পর্বঃ এখানে ক্লিক করুনclick here
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন