১১ জানুয়ারি, রাত ১০টা। হিম হিম বাতাস। শহুরে জীবনের যান্ত্রিকতা ছেড়ে ঘরে ফিরছে মানুষ। আলো ঝলমলে শীতল বাতাস গায়ে মেখে ঢুকলাম হাতিরঝিলে অবস্থিত প্রিয়াংকা শুটিং স্পটে। উদ্দেশ্য জনপ্রিয় অভিনেতা আ খ ম হাসানের সঙ্গে আড্ডা।
আর বিষয় হিসেবে এসেছে বর্তমান সময়ের ব্যস্ততা, স্বাধীন প্লাটফর্মে নাটক প্রকাশ ও দর্শক প্রতিক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয়।
কথায় কথায় হাসান জানালেন, নাটক কিংবা টেলিফিল্ম প্রচারের পর টেলিভিশনের চেয়ে ইউটিউবেই দর্শকদের সাড়া বেশি পাওয়া যায়।
এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, প্রিয়াংকা শুটিং স্পটে গতকাল ‘টাকলু’ নামের একটি নাটকের শুটিং চলছিল। যা শুধু ইউটিউবে প্রচার করা হবে। নাটকটির চিত্রনাট্য লিখেছেন ইশান কুমার। নির্মাণ করছেন রাজিব রসুল।
টেলিভিশন নাটকের পাশাপাশি ডিজিটাল কিংবা স্বাধীন প্ল্যাটফর্মগুলোত প্রচারিত নাটকেও নিয়মিত অভিনয় করছেন এই অভিনেতা। নাটক প্রচারের এই মাধ্যমগুলোকে কীভাবে দেখছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টেলিভিশনের জন্য নাটক বানালে নির্মাতা ও প্রযোজক এক ধরনের টেনশনে থাকেন। যেমন, প্রিভিউ করাতে হবে, চলবে কী চলবে না, কী কারেকশন দেবে চ্যানেল থেকে, সময় অনুযায়ী চলবে কী চলবে না। কিন্তু ইউটিউব চ্যানেলের জন্য কাজ করলে কারো কোনো ধরনের কোনো টেনশন থাকে না।’
‘কাজেরও স্বাধীনতা আছে। নির্মাতারা তাদের পছন্দসই আর্টিস্ট, গল্প নিয়ে কাজ করতে পারেন। ভালো গল্প, ভালো শিল্পী হলে কিন্তু কনটেন্টগুলো দর্শকপ্রিয়তা পায়। এখান থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবানও হন নির্মাতা কিংবা যার কাছে ইউটিউব রাইটস থাকে।’
টেলিভিশনে অভিনীত কোনো নাটক কিংবা টেলিফিল্ম দেখানোর পর দর্শকদের কাছ থেকে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া পান, ইউটিউবে প্রকাশের পর ঠিক কী ধরনের প্রতিক্রিয়া পান প্রশ্নে হাসান জানালেন, ‘টিভি থেকে আরও ব্যাপক। আমি বলব টেলিভিশনের চেয়ে ইউটিউবে রেসপন্স আরও বেশি। ইউটিউবে আমরা কিন্তু সাথে সাথেই জানতে পারছি কতজন দর্শক নাটকটা দেখেছে।’
‘নাটকের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ভুলগুলো নিয়ে আবার তারা তাদের মতামতও জানিয়ে থাকে। চ্যানেলে যে বিরক্তিকর জিনিসটা আছে-দুইটা দৃশ্য শেষ, এরপরই শুরু হয়ে যায় বিজ্ঞাপন বিরক্তি। এরপর ১০ মিনিট-১৫ মিনিট পর্যন্ত চলে। আমার মনে হয় না, কোনো দর্শক একসাথে বসে টেলিভিশনে কোনো নাটক একটানা দেখতে পারেন।’
‘আমি নিজেই পারি না। ধৈর্য ধরে রাখতে পারি না। এই যে বিজ্ঞাপন বিরক্তির একটা জায়গা সেটা ইউটিউবে নাই। যার কারণে দর্শক কোনো টেনশন ছাড়াই দেখতে পারে’,বলেন বোকা বাক্সের এ অভিনেতা।
একটা সময় গিয়ে ভিডিও আদান-প্রদান করার ওয়েবসাইট ইউটিউব বাংলাদেশে হয়তো টেলিভিশনের জায়গাটা নিয়ে নেবে। এমনটাই মনে করেন অভিনেতা আ খ ম হাসান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যুগের সাথে সাথে সবকিছুই পরিবর্তন হয়। আজ থেকে দশ বছর পরে টেলিভিশনটা হয়তো ইউটিউবের সাথে ম্যাচ হয়ে যাবে। এখন কিন্তু আমরা মোবাইলেই টিভি দেখতে পারি।’
বাংলাদেশে ডিজিটাল কিংবা স্বাধীন প্ল্যাটফর্মগুলো নিয়ে একটা বড় অভিযোগ আছে, চিত্রনাট্যের গুণগত মান কমে গেছে ও অশ্লীলতা ঢুকে গেছে—এই ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এই দিকটাতে সরকারের নজর দিতে হবে। আমরা যারা সচেতন, ভালো মানের কাজগুলো করছি সেটা ঠিক আছে। কিন্তু কিছু লোক ওই বাজে কাজগুলো করছে। যা খুবই বাজে। বলা চলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অশ্লীলতাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো ইউটিউবে তো অনেক সময় ব্যয় করে।’
‘এটা তাদের জন্য খুবই খারাপ একটা দিক। এই জিনিসগুলো প্রটেক্ট করার জন্য সরকারেরই এগিয়ে আসতে হবে, আমি বা আমরা পারব না। আশাকরি সরকার এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আমি যতটুকু জানি এ বিষয়টি নিয়ে সরকার কাজ শুরু করেছে।’
আড্ডার এক পর্যায়ে প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে স্বাধীন প্ল্যাটফর্মের সুযোগে ইউটিউবে কমেডির জায়গাটায় ভাঁড়ামির অতিরিক্ত বিষয়টি। এই অভিনেতা বলেন, ‘ভাঁড়ামি হলে কিন্তু দর্শক সেটা নিবে না। দর্শক এখন কিন্তু খুবই ট্যালেন্ট। আর আমরা সব ধরনের দর্শককের জন্যই কাজ করি। একজন দিনমজুর আর একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের রুচি একরকম হবে না।’
‘যার যার টেস্ট অনুযায়ী সে সে ধরনের নাটক দেখবে। যে যে সোসাইটিতে চলে সে তার অনুযায়ী দেখবে। মানুষ যে খারাপ সে খারাপটাই দেখবে, যে ভালো সে ভালোটাই দেখবে।’
অতিরিক্ত ভাঁড়ামো বা অশ্লীলতা ঠেকাতে নাটকের সংগঠনের ভূমিকার ব্যাপারেও কথা বলেন হাসান। তিনি বলেন, ‘আমাদের নাটকের ছয়টা সংগঠন আছে। তারা সবাই মিলে যদি সরকারকে কিছু বলে তারা নিশ্চয়ই শুনবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। সরকার-সগঠন তাদের মিলেই কাজটা করতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বললেই তো হবে না।’
আ খ ম হাসান মনে করেন, মানুষের সমাজিক চালচলন, আচার, ব্যবহার সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে ক্রোধ, প্রেম, হিংসা এইসব জিনিসগুলো একইরকম থেকে যায়। ঘুরে ফিরে দেখা গেছে নাটকে সে সব বিষয়গুলোর প্রতিফলন ঘটে।
টিভি নাটকের শিল্পীদের সংগঠন ‘অভিনয় শিল্পী সংঘ’-এর সাধারণ সম্পাদক ও অভিনয়শিল্পী আহসান হাবিব নাসিম। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে নাসিম জানান, দেশের প্রায় ৮২ শতাংশ শিল্পী এখন বেকার।
এই বক্তব্যের ব্যাপারে আ খ ম হাসানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘আমি একা সব কিছুর পরির্বতন করতে পারব না। এখানে আমার কী করার আছে? যদিও বিষয়টি শোনার পর খারাপ লাগছে। আমি কাজ করছি।’
‘কিন্তু আমার বেশিরভাগ সহশিল্পী কাজ করতে পারছেন না। আমি ইচ্ছে করলেই তো আমি আমার কলিগকে এখানে আনতে পারব না। এটা সম্পূর্ণ একটা বাণিজ্যিক জায়গা। এখানে মানবিকতা, ভালোবাসা ও স্নেহ কাজ করে না।’
কথার শেষের দিকে এই অভিনেতা জানান, বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে শুধু অভিনয়টাকে প্রধান ধ্যান-জ্ঞান মনে করে কাজ করে যাওয়ার অভিনয়শিল্পী খুব একটা তার চোখে পড়ে না। এর কারণে হিসেবে তিনি মনে করেন, অভিনয় শেখার পরিবেশটা আর আগের মতো নাই।
নিজের থিয়েটার জীবনের কথা স্মরণ করে আ খ ম হাসান বলেন, ‘আমি যখন থিয়েটার করতাম তখনও ভাবিনি আমি টিভি মিডিয়ায় এরকম অবস্থানে যাব। সবাই আমাকে ভালোবাসবে, প্রচুর কাজ করব, উপার্জন করব। সে সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসে করে ঢাকা আসতাম, থিয়েটার করতাম আবার চলে যেতাম। কিসের মিডিয়া, কিসের কি।’
‘এখন হয়তোবা অনেকেই ভেবে আসে, আমার ওই জায়গায় যাইতেই হইব। যেভাবেই হোক। আমরা অন্ধভাবে শিখছি। এখন হয়তো শেখার পরিবেশটাও আমাদের সময়ের মতো আর নাই। যার কারণে আজ এ অবস্থা।’
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন