‘তাজিন, লক্ষী বোন আমার। তুমি যেখানেই থাকো— শান্তিতে থাকো। কেউ তোমাকে কী ভাবে না ভাবে তাতে আমার কিছু আসে যায় না! আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করে ভালোবাসি। তোমাকে আমার আজানুলম্বা অভিবাদন।’ ফেসবুকে দীর্ঘ স্ট্যাটাসের শেষে এমনটা লিখলেন নির্মাতা কাউসার চৌধুরী।
তাজিন আহমেদকে স্মরণ করে ফেসবুকের ওই লেখায় দুটি ঘটনা উল্লেখ করেন কাউসার। তিনি জানান, গায়ক সঞ্জীব চৌধুরীর চিকিৎসার জন্য চুড়ি বিক্রি করেছিলেন প্রয়াত এ অভিনেত্রী। বাপ্পা মজুমদারের বরাত দিয়ে লেখেন, ‘তাজিন তার হাতের চুড়িগুলো বিক্রি করে সঞ্জীব’দার চিকিৎসার জন্য।’
কাউসার চৌধুরী পুরো ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেন, “সঞ্জীব চৌধুরী (গায়ক-সাংবাদিক) যখন অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ শয্যা পেতেছে, তখনো তাজিন কিন্তু সঞ্জীবের চারপাশেই ঘুরেছে চরকীর মতো। ঢাকার সব শিল্পী-সাহিত্যিক আর সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এই হাসপাতালে। সঞ্জীব যে ক’দিন এই হাসপাতালে শুয়ে ছিল, আমিও যেতাম নিয়মিত! সেই সময়ে তাজিনকে দেখতাম চিকিৎসার টাকা যোগাড় করা থেকে আরো অনেক বৈষয়িক কাজে টুকটুক করে দৌড়াচ্ছে এদিক সেদিক।
তাজিন আবার সঞ্জীবের শিষ্য। ভোরের কাগজে ‘মেলা’ আর সংস্কৃতির পাতায় লিখবার জন্য সঞ্জীবের যে বিশাল বাহিনী ছিল তাজিন তার অন্যতম সৈনিক! সুতরাং গুরুর বিপদে শিষ্য দৌড়াবে সেটাই তো সঙ্গত।
আমি তখোন মোহাম্মদপুর আদাবরে ১২ নম্বর সড়কে থাকি। তাজিনও থাকতো আদাবরে আমাদের বাসার কয়েকটি সড়ক পরে। সেই সময়ে আমার ছোট্ট একটি গাড়ি ছিল, স্টেশন ওয়াগন। আমি নিজেই ড্রাইভ করতাম। সঞ্জীবকে ‘পাহারা’ দিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ১১টা কী ১২টা বেজে যেতো। তাজিন আমার গাড়িতেই ফিরতো আদাবরে। পরদিন সকালে আবার আমরা ওই একই গাড়িতেই অ্যাপোলোতে চলে যেতাম। দু’দিন টানা ‘ডিউটি’ করার পরে তৃতীয় দিনে একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠলাম। খবর পেলাম ততক্ষণে তাজিন এসে বসার ঘরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে! আমি ব্যস্তসমস্ত হয়ে তাজিনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি অ্যাপোলোর উদ্দেশ্যে।
আমি ড্রাইভ করছি, তাজিন আমার পাশের সিটে বসে আছে। গাড়ি প্রায় জাহাঙ্গীর গেট (ক্যান্টনমেন্ট) ক্রস করছে। এমন সময় লক্ষ্য করি তাজিনের হাতদু’টো ন্যাংটো! অথচ এর আগের দিনও দেখেছি ওর হাতভর্তি সোনার চুড়ি। আমি একটু অপ্রস্তুতভাবে জিজ্ঞেস করে বসি- কীরে তাজিন, তোর হাতের চুড়িগুলো কোথায়! তাজিন হেসে বলে- কেন, হাইজ্যাক করবেন নাকি (হাসি)! প্রত্যেকদিন রাত করে আপনার সাথে ফিরি তো, ভাবলাম, কোনদিন না আবার হাইজ্যাক করে বসেন (হাসি)! না বাবা, পুরুষ মানুষের বিশ্বাস নেই (আবারো হাসি)! সে হাসতেই থাকে।
ওর হাসিতে আমার গায়ে জ্বালা ধরে যায়! বলি- ফাজলামো করিস না। বল কী হয়েছে! তাজিন ঠাণ্ডা মাথায় বললো- না, চুড়িগুলো মা’র কাছে রেখে এসেছি। দাদা (সঞ্জীব) অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে, বাঁচা-মরার মাঝখানে দুলছে, এমন সময়ে অলংকার পরে দাদার পাশে যেতে ইচ্ছে করছে না! তাই আম্মার কাছে রেখে এসেছি। আমি আপাতত মাথা নেড়ে সায় দেই ওর কথায়, কিন্তু মনের ভেতরে কী একটা যেনো খচখচ করে বিধতে থাকে!
ওইদিন বিকেলে খুব ক্লান্ত হয়ে বাপ্পা (বাপ্পা মজুমদার) আর তুষারকে (আব্দুন নূর তুষার) নিয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালের ফুডকোর্টে গিয়ে একটু গরম চা পান করছিলাম। তুষার যেহেতু ডাক্তার মানুষ, ও বেশ স্বাভাবিক আচরণ করছিল সবার সাথে। ওর কথায় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস আর অনেক দৃঢতা! কিন্তু বাপ্পাকে দেখি অনেক বেশি ঝুলে আছে, ভেঙ্গে পড়েছে প্রায়! চা পানের একফাঁকে আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো- তাজিনের কাণ্ডটা দেখেছেন! আমি চমকে ওর মুখের দিকে তাকাই। বাপ্পা বলে- তাজিন তার হাতের চুড়িগুলো বিক্রি করে সঞ্জীব’দার চিকিৎসার জন্য টাকা নিয়ে এসে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে!
আমার সারা গায়ে বাজ পড়ল যেন! এই বয়সের একটি মেয়ে এমন ভালোবাসার, শ্রদ্ধার একটি নজির স্থাপন করতে পারে, সেটা ভাববার মতো মনের প্রসারতা আমার মনে তখনো হয়নি! গুরুর জন্য একজন মানুষ এই যুগে এতটা ত্যাগ করতে পারে? অবিশ্বাস্য!
সঞ্জীবের চিকিৎসা খরচের কোন সমস্যা হচ্ছিল- তেমন কিন্তু নয়। কিন্তু তারপরেও তাজিনের বয়সী একটি মেয়ে এভাবে হৃদয় খুলে এগিয়ে আসা, এ যে কত মহৎ হৃদয়ের ব্যাকুলতা, সেটা বুঝবার ক্ষমতা কি এখনকার মানুষগুলোর নেই?”
মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তাজিন। বুধবার বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন