দেশের শেয়ারবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডের দুর্দিন যাচ্ছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৭টি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩১টিরই লেনদেন হচ্ছে ডিসকাউন্টে। অর্থাৎ ফান্ডগুলোর বর্তমান বাজারদর সেগুলোর নিট সম্পদমূল্য (এনএভি) ও অভিহিত মূল্যের (ফেসভ্যালু) চেয়ে কম। এতে করে এই নিরাপদ বিনিয়োগ খাত হয়ে গেছে বিনিয়োগকারীর গলার কাঁটা। পুঁজির চেয়ে ফান্ডের মূল্য কম হওয়ার কারণে তাদের অনেকেই ভুগছেন সিদ্ধান্তহীনতায়; মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে তাদের হতাশা ক্রমেই বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মিউচুয়াল ফান্ড কাঠামোতে একটি অ্যাসেট ম্যানেজার বা সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ছোট ছোট সঞ্চয় সংগ্রহ করে একটি বড় ফান্ড গঠন করে। এরপর ওই ফান্ড থেকে সম্পদ ব্যবস্থাপক তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার, অর্থবাজারের বিভিন্ন পণ্য বা সেবা, সরকারি ও করপোরেট বন্ডে বিনিয়োগ করে। উদ্দেশ্য থাকে ফান্ডটির অর্থ বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা।
জানা গেছে, সারা বিশ্বেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পছন্দের শীর্ষে থাকে মিউচুয়াল ফান্ড। বিশেষ করে পুঁজিবাজারের উত্থান-পতন পরিস্থিতি অনুধাবন করার মতো সম্যক জ্ঞান না থাকা বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র এ ফান্ড। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বিনিয়োগকারীদের কাছে মিউচুয়াল ফান্ড বেশ জনপ্রিয়। অথচ বৈশ্বিক এমন পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। পাঁচ দশকেও দেশে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি এ খাত।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো পরিচালনা করার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপকরা সেই দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারছেন না। সম্পদ ব্যবস্থাপকের দক্ষতার সঙ্গে ফান্ড ব্যবস্থাপনা করতে না পারার কারণেই সেখান থেকে বিনিয়োগকারীরা কাক্সিক্ষত রিটার্ন পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে সম্পদ ব্যবস্থাপকদের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ফি নির্ধারণ করা, সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির রেটিং করাসহ তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, দু-চারটি ছাড়া কোনো মিউচুয়াল ফান্ড ভালো করছে না। বেশির ভাগই সম্পদমূল্যের নিচে বিক্রি হচ্ছে। ফলে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। এক্ষেত্রে তিনি ফান্ড ম্যানেজারদের অদক্ষতাকে দায়ী করেছেন। পাশাপাশি যেসব ফান্ড ম্যানেজার অনিয়ম করে টাকা বের করে নিয়েছেন, ঠকবাজি করেছেন, তাদের ফান্ড বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রথম ২০০০ সালে মিউচুয়াল ফান্ড আনে এইমস বাংলাদেশ। সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াওয়ার সাঈদ গতকাল রবিবার আমাদের সময়কে বলেন, দেশের অর্থনীতির কোনো দিকই ভালো যাচ্ছে না। শেয়ারবাজার বা মিউচুয়াল ফান্ড এর বাইরে নয়। তবে এটি ঠিক যে, অনেক ফান্ডে অনিয়ম-লুটপাট হয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপকরা দক্ষতা ও সক্ষমতার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। এটি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ফান্ডের পারফরম্যান্সে এর প্রতিফলন হতো এবং বিনিয়োগকারীরা ভালো রিটার্ন পেতেন। এজন্য সম্পদ ব্যবস্থাপকদের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ফি নির্ধারণ করার
বিষয়টি চালু করা প্রয়োজন। অন্যান্য দেশে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলোর রেটিং রয়েছে, যা আমাদের দেশেও চালু করা যেতে পারে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ট্রাস্টিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট যেসব আইন রয়েছে, সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সার্বিকভাবে মিউচুয়াল ফান্ডের উন্নয়নে খাতসংশ্লিষ্ট সবারই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
জানা গেছে, বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত পুঁজি একত্র করে মিউচুয়াল ফান্ড গঠন করে থাকে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলো। ফান্ডের অর্থ পুঁজিবাজার ও মুদ্রাবাজার দুই ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা ২০০১-এর বিধান অনুসারে, এক্ষেত্রে ফান্ডের মোট অর্থের ৬০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হবে, যার অর্ধেক অর্থ আবার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করতে হবে। মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর পোর্টফোলিওতে থাকা অন্তর্নিহিত সম্পদের ওপর ফান্ডগুলো থেকে বিনিয়োগকারীদের রিটার্নের পরিমাণ নির্ভর করে। এক্ষেত্রে পোর্টফোলিওতে থাকা সম্পদের মান ভালো হলে সেখান থেকে ভালো রিটার্ন আসে এবং সেই ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকে। এতে লভ্যাংশের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীরা ফান্ডের ইউনিট বিক্রি করে মূলধনি মুনাফাও অর্জন করতে পারেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেশের মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর সম্পদের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন সময় অতালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ বিনিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তদন্তেও এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ ও নিয়মবহির্ভূত বিনিয়োগের বিষয়টি ধরা পড়েছে। সম্পদ ব্যবস্থাপকদের এ ধরনের প্রবণতার কারণে মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে কাঙ্ক্ষিত হারে রিটার্ন পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ফার্স্ট জনতা মিউচুয়াল ফান্ড সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৪ টাকা ৫০ পয়সায়, এবিবি ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৪ টাকা ৫০ পয়সায়, এআইবিএল ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৯ টাকা ৬০ পয়সায়, এটিসিএসএলজিএফ ৭ টাকা ৩০ পয়সায়, ডিবিএস ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৫ টাকা ৭০ পয়সায়, ক্যাম্পবিডি ৭ টাকা ৮০ পয়সায়, ইবিএল ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৫ টাকা ২০ পয়সায়, ইবিএলএনআরবি মিউচুয়াল ফান্ড ৪ টাকা ৭০ পয়সায়, এক্সিম ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৪ টাকা ৫০ পয়সায়, এফবিএফআইএফ ৪ টাকা ৫০ পয়সায়, গ্রীনডেল্টা মিউচুয়াল ফান্ড ৫ টাকা ২০ পয়সায়, আইসিবি থার্ড আরডিএনআরডি ৫ টাকা ৫০ পয়সায়, আইসিবি অগ্রণী ফার্স্ট ৭ টাকা ৫০ পয়সায়, আইসিবিএমসিএল সেকেন্ড ৭ টাকা ৭০ পয়সায়, আইসিবিইপি মিউচুয়াল ফান্ড ফার্স্ট ওয়ান ৬ টাকা ২০ পয়সায়, আইএফআইসি ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৪ টাকা ৪০ পয়সায়, আইএফআইএলআইএসএল মিউচুয়াল ফান্ড ওয়ান ৫ টাকা ৭০ পয়সা, এলআরগ্লোবাল মিউচুয়াল ফান্ড ওয়ান ৫ টাকা, এমবিএল ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৬ টাকা ৭০ পয়সায়, এনসিসিবিএল মিউচুয়াল ফান্ড ওয়ান ৫ টাকা ৮০ পয়সায়, পিএফ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৭ টাকা ১০ পয়সায়, পপুলার ওয়ান মিউচুয়াল ফান্ড ৪ টাকা ৫০ পয়সায়, প্রাইমওয়ানআইসিবিএ ৬ টাকা ৪০ পয়সায়, এসইএমএলএফবিএসএলজিএফ ৬ টাকা ৬০ পয়সায়, এসইএমএলআইবিবিএলএসএফ ৭ টাকা ৫০ পয়সায়, ভিএএমএলবিডিএমএফ ওয়ান ৬ টাকায় এবং ভিএমএলআরবিবিএফ ৫ টাকা ৭০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন