এফডিআইয়ে প্রধান তিন বাধা চিহ্নিত :: মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ :: শাসনব্যবস্থার উন্নতি ও দুর্নীতি রোধ করা জরুরি
গত এক দশকে দেশের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছিল। প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল ছিল। তবে গত তিন বছর ধরেই বৈশ্বিক দুই বড় ঘটনার প্রভাবে টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে দেশের অর্থনীতি। প্রথমে কোভিড-১৯ মহামারী ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। উভয় কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। কমে যায় প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স)। তার ওপরে আছে অভ্যন্তরীণ কারণ। ঠিক সময়ে যথাযথ নীতি প্রণয়ন করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে দেশে এক ধরনের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়। এর ফলে দেশের অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই নানামুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। গত মাসে আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়ের পর প্রকাশ করা মেমোরেন্ডামে একগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে। তাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার বিষয়টিকে হতাশাজনক উল্লেখ করে অর্থনীতির জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে।
ডলার সংকট এখন দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গেলে ব্যবসায়ীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ব্যবসায়ীরা নিজেদের আয়ই ব্যাংক থেকে ডলারে ফেরত পাচ্ছেন না। সংকটের কারণে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে বাজারের পণ্যমূল্যেও। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলারের জোগান দিতে গিয়ে কমে আসছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে উন্নয়ন সহযোগীদের দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের টাকা ফেরত দেওয়ার ইতিহাস ভালো হওয়ায় এগিয়ে আসে উন্নয়ন সহযোগীরাও। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন এবং এর প্রথম কিস্তির টাকাও ছাড় করেছে, যার পর পরই বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্ক তুলে ধরেছে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ।
বৈশ্বিক সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান বাধাকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান তিনটি বাধা হলোÑ উচ্চ শুল্ক-অশুল্ক বাধা, অবকাঠামোসহ উপযুক্ত পরিবেশ না থাকা এবং আস্থার সংকট। ফলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ কৃষি উৎপাদন বাড়লেও শিল্প উৎপাদনে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। এমনকি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে খুবই হতাশাজনক অবস্থা বিরাজ করছে।
সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বাংলাদেশে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির প্রধান ঝুঁকি হলো প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে আর্থিক নীতি শিথিল করার সুযোগ সীমিত থাকা, সংকুচনমূলক আর্থিক খাত, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ ক্ষয়। এসব বিষয়ে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। দেশের অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এগুলো নিজেদের প্রয়োজন এবং উদ্যোগেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ছাড়া আইএমএফের পর্যবেক্ষণে দেশের অন্যান্য ঝুঁকির মধ্যে বাজেট বাস্তবায়ন ক্ষমতার দুর্বলতা, কিছু সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অস্থায়ীভাবে পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যে কোনো দেশের বিনিয়োগ বাড়াতে একটি সুষ্ঠু ও উপযুক্ত পরিবেশ এর পূর্বশর্ত, যা বৈদেশিক বাণিজ্যকে প্রসারিত করে। একই সঙ্গে এফডিআই আকর্ষণ করতে সাহায্য করে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই পরিবেশ উপযুক্ত নয়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে নেওয়া অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও এফডিআইয়ের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ পদক্ষেপেই তুলনামূলক কম উপযুক্ত। একইভাবে এখানে উচ্চশুল্ক ও অশুল্ক বাধা রয়েছে। যেগুলো হ্রাস করা খুবই জরুরি। এমনকি গত এক দশক ধরে অবকাঠামো খাতে সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করলেও উপযুক্ত অবকাঠামো এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ-জ্বালানির চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক ও পুঁজির অনিশ্চয়তা। যার ফলে বিনিয়োগকারীরা আস্থার সংকটে ভোগেন বলে মনে করে আইএমএফ।
এতে আরও বলা হয়, এখানে শাসনব্যবস্থার উন্নতি এবং দুর্নীতি কমাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এ ছাড়া ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা সম্ভব নয়। এভাবে বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আর্থিক শাসন ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য আর্থিক খাতের সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকারি সেবা খাতগুলোর উন্নয়ন ও সরকারি পরিষেবাগুলোর আরও ডিজিটালাইজেশন এবং বিরোধীদের স্বাধীনতা রক্ষা করাও জরুরি। এতে দুর্নীতি কমিশনকে আরও কার্যকর করা এবং কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেলের দপ্তরের স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে।
এদিকে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে পুঞ্জীভূত এফডিআই কমেছে ৫ শতাংশ। অথচ এ সময়ে ভারত ও মিয়ানমারের মতো দেশও বিদেশি বিনিয়োগ টানতে বেশ কার্যকর স্বাক্ষর রেখেছে। যার ফলে দেশ দুটির উৎপাদন বাড়ছে। বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে এফডিআই। এক যুগের বেশি সময় আগে ২০০৯-এর শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের সময় দেশে মোট পুঞ্জীভূত এফডিআই (এফডিআই স্টক) ছিল প্রায় ৪৮২ কোটি ডলার, যা ২০২১ সালের শেষে প্রথমবারের মতো ২১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে। ওই সময় এফডিআইয়ের স্টক দাঁড়ায় ২ হাজার ১৫৮ কোটি ১৯ লাখ ডলারে। সেখান থেকে প্রায় ৫ শতাংশ বা ১০৭ কোটি ৮৩ লাখ ডলার কমে ২০২২ সালের প্রথমার্ধ শেষে দেশে এফডিআইয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৫০ কোটি ৩৫ লাখ ডলারে।
এদিকে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের প্রভাবে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে অব্যাহতভাবে। ফলে দেশে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। যার অন্যতম কারণ হলোÑ কাক্সিক্ষত হারে বিদেশি বিনিয়োগ না আসা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, ‘আইএমএফের বলা সংস্কারগুলো দেশের অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন। শর্তগুলো যৌক্তিক। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে সংস্থাটি যে উদ্বেগ দেখিয়েছে বা ঝুঁকির কথা বলেছে তা অমূলক নয়। কেননা আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ টেকসই বা সহনশীল নয়। এখানে অনেক অসহনীয় বিষয় রয়েছে, যেগুলো অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক। তবে এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো ঋণ কর্মসূচি। তবে এটি আমাদের জন্য ইতিবাচক যে, আইএমএফ এখন সংকট এড়াতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘যে কোনো দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে বিনিয়োগ হয় না, বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ে না। আইএমএফ যেসব পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি, রপ্তানি বৃদ্ধি, রাজস্ব আহরণ বাড়ানোÑ এগুলো আমাদের নিজেদের স্বার্থেই করতে হবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন