সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক হিসাব থেকে দেখা যায়, দেশে দ্রুত বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা। করোনার সময় থেকে চলতি বছর অবধি যখন দেশের অর্থনীতি টালমাটাল, চাকরি হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ, অনেক ব্যবসায়ী তলিতল্পা গুটিয়ে ফিরে গেছেন গ্রামে, বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষককে পেটের দায়ে সবজি বিক্রি করতে হয়েছে, রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় ওয়েটার হয়েছেন রিকশাচালক, বাবার চাকরি চলে যাওয়ায় ছাত্রাবস্থায়ই সন্তানকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে ফেরিওয়ালা হয়ে, ঠিক একই সময়ে এ দেশে দু-বছরের ব্যবধানে নতুন করে কোটিপতি হয়েছেন ১৮ হাজার ১৩৭ জন।
এ ক্ষেত্রে সেই বিদ্যালয়ের শক্তির নিত্যতা সূত্রটি খাপে খাপ মিলে যায়। সূত্রটিতে বলা হয়েছিল, মহাবিশ্বে শক্তির সৃষ্টি কিংবা ধ্বংস নেই। কেবল এক রূপ থেকে অন্যরূপে পরিবর্তন হয় মাত্র। এ দেশের অর্থনীতিতেও ঘটছে একই ঘটনা–এক পকেট থেকে আরেক পকেটে টাকা যাচ্ছে। মাঝখানে অসংখ্য পকেট থেকে যাচ্ছে শূন্য।
করোনাকালীন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, তা কোটিপতিদের পরিসংখ্যান থেকে সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু কারা আসলে কোটিপতি–এ প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশ সময় সংবাদকে বলেন, 'আপনি সব সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংকে কয়েক কোটি টাকা রাখলেন কিংবা লটারিতে এক কোটি টাকা জিতলেন, এতে কিন্তু আপনাকে কোটিপতি বলা যাবে না। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যখন আপনার টাকার প্রবাহ কোটির ওপরে কিংবা এর কাছাকাছি থাকবে, তখন আপনাকে কোটিপতি বলে গণ্য করা হবে।’
এ ব্যাপারে ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, কোটি টাকার হিসাবপত্রকেই কোটিপতি বলা যায় না। যেকোনো বড় প্রতিষ্ঠানের কোটি টাকার হিসাবপত্র থাকতে পারে। মূলত ব্যক্তি হিসাবকে কেন্দ্র করেই কোটিপতিদের এ পরিসংখ্যান দাঁড় করানো হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য থেকে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচজন। তিন বছর পর ১৯৭৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। পাঁচ বছর পর ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে কোটিপতি ছিলেন ৯৮ জন। ১০ বছর পর ১৯৯০ সালে এ সংখ্যা ৯৪৩ জনে উন্নীত হয়। ২০০১ সালে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা হয় ৫ হাজার ১৬২ জন। ২০০৮ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ১৬৩ জনে। ২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ধরনের উম্ফলন দেখা যায়। ২০১৯ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩ হাজার ৮৩৯ জনে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯৩ হাজার ৮৯০ জন। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬ জন।
সবশেষ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত পাওয়া ব্যাংক হিসাবের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১ কোটি ১ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ৮৪১ জনে। ব্যাংকে এদের জমা করা টাকার পরিমাণ ১ লাখ ৭৬ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। ৫ কোটি থেকে ১০ কোটির মধ্যে রয়েছে ১১ হাজার ৮৬৫টি হিসাব এবং এদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করা টাকার পরিমাণ ৮৪ হাজার ৬৬ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ১০ কোটি ১ টাকা থেকে ১৫ কোটি টাকার হিসাব রয়েছে ৩ হাজার ৭৬৩টি, ১৫ কোটি ১ টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে ১ হাজার ৭১৯টি, ২০ কোটি ১ টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে ১ হাজার ১৫১টি, ২৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ৮৮৩টি, ৩০ কোটি ১ টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৫০২টি, ৩৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৩০৭টি, ৪০ কোটি ১ টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা ৬২১টি ও ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানতকারীর সংখ্যা ১ হাজার ৮০৫টি।
বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশে গুটিকয়েক মানুষের এমন দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য কতটা শোভন–এ বিষয়ে এম এম আকাশ বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজিবাদের ঝান্ডাধারী ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে আদমজী ছিল অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের পর গৃহীত সংবিধানের অন্যতম একটি মূলনীতি ছিল সমাজতন্ত্র এবং এ ব্যবস্থায় কারোরই কোটিপতি হওয়ার কথা ছিল না। এ ছাড়াও সংবিধানে আরেকটা কথা বলা আছে যে অনুপার্জিত অর্থ নেয়া যাবে না। অর্থের মালিক হতে হলে তা উপার্জন করে নিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে যারা কোটিপতি হয়েছেন বা হচ্ছেন, তাদের সিংহভাগই ঋণখালেপি, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, ব্যাংক থেকে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিংকারী। এখানে অনেক মানুষই বড় প্রজেক্টগুলোর অর্থ লুটে, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে জনগণকে চাপে ফেলে, ঠিকাদারিতে ১ টাকার খরচকে ১০০ টাকা দেখিয়ে কোটিপতি হয়েছেন।
আকাশ বলেন, এ দেশে মানুষ হয় বেআইনিভাবে কিংবা একচেটিয়া বাজারে পুঁজিবাদী শোষণতন্ত্রের মাধ্যমে কোটিপতি হয়েছেন। বেআইনিভাবে যারা কোটিপতি হয়েছেন, তাদের অর্থ বৈধ না আর পুঁজিবাদী শোষণতন্ত্রের মাধ্যমে যারা কোটিপতি হয়েছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যচ্যুত মানুষ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ২২টি পুঁজিবাদী পাকিস্তানি পরিবারের বিরুদ্ধে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে আমরা ২২ পরিবারের জায়গায় ১ লাখ পরিবার দাঁড় করিয়েছি, যা আমাদের জন্য অপমানকর, লজ্জাজনক এবং আমরা পথভ্রষ্ট।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন