করোনার বৈশ্বিক মহামারি আর ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার বাধ্যবাধকতায় ২০২০ সালে পরিচালন মুনাফায় ধস নেমেছিল দেশের ব্যাংক খাতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন ছাড়ে এক বছরেই ব্যাংকগুলোর আয় খাত ঘুরে দাঁড়ায়। এরপরও সদ্যসমাপ্ত ২০২১ সালে দেশের হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক বাদে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফায় ভালো করতে পারেনি। অর্থাৎ দেশের শীর্ষ ১০ ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। আবার গ্রাহকের আমানত নিতে অনীহারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রায় ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে হাজার কোটি টাকার বেশি পরিচালন মুনাফার ঘরে যুক্ত হয়েছে মাত্র ৯ ব্যাংক। তবে দেশের বড় ব্যাংকগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আগের বছরের মতো ২০২১ সালেও ঋণ শ্রেণিকরণ বা খেলাপি ঋণের মেয়াদ গণনায় ব্যাপক ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নানা ছাড়ের কারণেই দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়।
তবে পরিচালন মুনাফায় বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির পরও অনেক ব্যাংকই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিট মুনাফা অর্জন করতে ব্যর্থ হবে বলে তারা জানিয়েছেন। এদিকে অনেকেই জানিয়েছেন দেশের একটি ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের আমানত নিতেও অনীহা প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেকই রয়েছে শীর্ষ ৫ ব্যাংকে। বাকি ৫৬টি ব্যাংকে অর্ধেকের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে। মোট খেলাপি ঋণের ৬২ শতাংশের বেশি রয়েছে শীর্ষ ১০টি ব্যাংকে। বাকি ৫১টি ব্যাংকে রয়েছে ৩৭ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ। দেশের ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে ৫টি ব্যাংকে। অর্থাৎ ৫০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৫৬টি ব্যাংকে রয়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে শীর্ষ ১০টি ব্যাংকে রয়েছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৫১টি ব্যাংকে রয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ থাকায় শীর্ষ ৫টি ব্যাংকের বেশি ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে শীর্ষ ১০টি ব্যাংকের ঝুঁকিও কম নয়। তবে শীর্ষ ৫ ব্যাংকের চেয়ে কম। খেলাপি ঋণের কারণে এসব ব্যাংকের মোটা অঙ্কের অর্থ প্রভিশন খাতে আটকে রয়েছে। এর বিপরীতে মূলধন ঘাটতিও রয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিকভাবে মোট ঋণের ৩ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ হলেই ওই ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে মোট সম্পদের ৪৭ শতাংশই রয়েছে ১০ ব্যাংকের হাতে। বাকি ৫১ ব্যাংকের হাতে রয়েছে ৫৪ শতাংশ সম্পদ। শীর্ষ ৫ ব্যাংকের হাতে রয়েছে ৩২ শতাংশ সম্পদ। বাকি ৫৬ ব্যাংকের হাতে রয়েছে ৬৮ শতাংশ সম্পদ। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুষম প্রতিযোগিতা না থাকার কারণে সম্পদ আহরণেও বৈষম্য রয়েছে। ব্যাংকগুলোর সম্পদ বলতে ঋণকে বোঝায়।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে ৭টি ব্যাংকের। ১৫ শতাংশের বেশি থেকে ২০ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে ৫টি ব্যাংকের। ১০ শতাংশের বেশি থেকে ১৫ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে ৩টি ব্যাংকের। ৫ শতাংশের বেশি থেকে ১০ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে ১০টি ব্যাংকের। ৩ শতাংশের বেশি থেকে ৫ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ আছে ১৯টি ব্যাংকের। ২ শতাংশের বেশি থেকে ৩ শতাংশের কম খেলাপি রয়েছে ৮টি ব্যাংকের। ২ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ আছে ৯টি ব্যাংকের।
ওদিকে গত বছর হাজার কোটি টাকা মুনাফা করা ব্যাংকগুলোর তথ্যে দেখা গেছে, ২০২১ সালে ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা মুনাফা করে শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। আগের বছর ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এরপরই ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। ব্যাংকটির মুনাফা হয়েছে ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। মুনাফায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পূবালী ব্যাংক। ব্যাংকটি ১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এরপরই হাজার কোটি টাকা মুনাফায় আছে দি সিটি ব্যাংক। ব্যাংকটি ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। আগের বছর সিটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ৭১৪ কোটি টাকা। ইউসিবি মুনাফা করেছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংক প্রতিটি ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। ব্যাংক এশিয়া মুনাফা করেছে ১ হাজার ৩৮ কোটি টাকা ও সাউথইস্ট ব্যাংক ১ হাজার ১৬ কোটি টাকা। এদিকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে আইএফআইসি ব্যাংকের। ১৪৪ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ৭৭৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করে প্রবৃদ্ধির শীর্ষে আছে ব্যাংকটি। এরপরই ৭৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়া মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৭২২ কোটি টাকা। ৭১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়া মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৬০১ কোটি টাকা। আর মুনাফায় ৫৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ইউসিবির। ৪৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়া শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৭১৭ কোটি টাকা।
পরিচালন মুনাফা কোনো ব্যাংকের চূড়ান্ত মুনাফা নয়। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যে মুনাফা থাকে, সেটিই কোনো ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। এ মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করতে হয়। প্রভিশন ও কর-পরবর্তী এ মুনাফাই হলো একটি ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা।
এদিকে মুনাফায় খারাপ করা দেশের বড় ব্যাংকগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে। ২০২১ সালে মাত্র ২৪৮ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা দেখাতে পেরেছে ব্যাংকটি। যদিও আগের বছর ৯২০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জনের দাবি করেছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। পরিচ্ছন্ন হিসাবের কারণে এবার ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা কমেছে বলে ব্যাংকটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ ছাড়া ২০২১ সালে এক্সিম ব্যাংক ৭৮০ কোটি টাকা, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ৭৫০ কোটি টাকা, যমুনা ব্যাংক ৭৫০ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংক ৭২১ কোটি, এনসিসি ব্যাংক ৭১৭ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৬৯০ কোটি ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ৫০৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু করা চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোও বিদায়ী বছরে ভালো মুনাফা পেয়েছে। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক ৩৭৫ কোটি, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ২১০ কোটি, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ৪৫০ কোটি, মেঘনা ব্যাংক ১০৫ কোটি, মিডল্যান্ড ব্যাংক ১৬২ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ২৬৮ কোটি ও মধুমতি ব্যাংক ২১৬ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী মাসরুর আরেফিন বলেন, বহুমুখী সেবা ও ব্যবসা পরিচালনা করে, এমন ব্যাংকগুলোই সদ্যসমাপ্ত গত বছরে ভালো করতে পেরেছে। ২০২১ সালে যেসব ব্যাংক আমানতের সুদ কমিয়ে কস্ট অব ফান্ড কমাতে পেরেছে, সেগুলোও ভালো পরিচালন মুনাফা পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা শুনছি একাধিক দুর্বল ব্যাংককে একত্র করে অন্য ব্যাংকের একীভূত করে দেয়া।
দেশের ব্যাংকগুলোর ২০১৯ ভিত্তিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং থেকে জানা গেছে, ১০টি ব্যাংক প্রান্তিক অবস্থায় রয়েছে। আর ৯টি ব্যাংকের অবস্থা মোটামুটি ভালো। বাকি ৩৮টি ব্যাংকের অবস্থা সন্তোষজনক।
মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, যারা ভালো করেছে তারা বরাবরই ভালো করেছে। আবার অনেক ব্যাংকের সব কিছু ভালো ছিল কিন্তু খারাপ করেছে। গ্রাহকের যারা আস্থায় রাখতে পেরেছে তারা সব সময় ভালো করেছে বলে জানান তিনি। এছাড়া করোনা মহামারির ধাক্কা অনেক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় আঘাত করেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমানত রাখতে এসে কারও আমানত ফেরত দেয়া হয়েছে এমন তথ্য তার জানা নেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন