আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজন মনে করলে কোনো ব্যাংকের ব্যবসা স্থগিত, মুনাফা বিতরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে। তারপরও ব্যাংক দুর্বল হয়ে গেলে কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে ওই ব্যাংকের অবসায়ন বা একীভূতকরণ করতে পারবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে গঠন করা হবে একটি ‘স্থায়ী কমিটি’। অবসায়ন বা একত্রীকরণ প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে মেনে চলতে হবে। পুনর্গঠন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংককে বেশকিছু ক্ষমতাও দেওয়া হচ্ছে।
বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এ ‘দুর্বল ব্যাংক-কোম্পানি ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক নতুন একটি অধ্যায়ে বেশকিছু বিষয় সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ অধ্যায়ে দুর্বল ব্যাংক কোম্পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের আওতায় এর পুনর্গঠন, একত্রীকরণ, অধিগ্রহণ ও অবসায়নের বিষয়ে বিদ্যমান পঞ্চম ও ষষ্ঠ খ-কে নতুনভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু ‘ব্যাংক কোম্পানি অধিগ্রহণ’ এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু ‘ব্যাংক কোম্পানির ব্যবসায় সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা ও অবসায়ন’।
বলা হয়, অধ্যায়গুলোর অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কোনো আদেশের ফলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের কাছে আপিল করতে পারবে এবং ওই পর্ষদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। এই অধ্যায়ের অধীনে গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, আদেশ বা সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না। অনুরূপ কোনো ব্যবস্থা আদেশ বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন বা কার্যধারা গ্রহণ করা যাবে না।
এসব বিধান যুক্ত করে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। নতুন আইনের খসড়ার ব্যাপারে মতামত চেয়েছে বিভাগটি। খসড়ায় ৫০টিরও বেশি ধারা-উপধারা সংযোজন, পরিমার্জন ও সংযোজন করা হয়েছে। খসড়ার ওপর সংশ্লিষ্টদের মতামত ও পর্যালোচনার পর তা চূড়ান্ত করবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
নতুন সংযোজিত এ সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে কোনো ব্যাংকের ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা, ব্যাংক পুনর্গঠন, অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ, ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি ও অবসায়ন করতে পারবে। কোনো ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা থাকবে। ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর কোনো পরিচালক অপসারণ করে তার শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে বিক্রয় বা হস্তান্তর করতে পারবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার
যদি মনে করে, কোনো ব্যাংক সঠিকভাবে পরিচালিত হতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং তাতে আমানতকারীদের ক্ষতি হতে পারে, তখন সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অধিগ্রহণ করতে পারবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের লিখিত পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে নতুন কোনো ব্যাংক-ব্যবসায় নিয়োজিত হতে বা সম্প্রসারণ করতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের লিখিত পূর্বানুমোদন ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত বার্ষিক ভিত্তিতে তার ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ঋণ বা অগ্রিম) বৃদ্ধি করতে পারবে না এবং নগদ মুনাফা বণ্টনও করতে পারবে না।
এই আইনের দুর্বল ব্যাংক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত বিশেষ বিধানে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যাংক কোম্পানি এরূপ বিবেচনা করে, এই ব্যাংক কোম্পানির বিদ্যমান আর্থিক অবস্থা অর্থাৎ এর তারল্য, সম্পদের গুণগত মান ও মূলধন পরিস্থিতি এরূপ অবস্থায় উপনীত হয়েছে যে বাংলাদেশ ব্যাংকে নির্ধারিত পরিমাণে, হারে ও পন্থায় তারল্য, সম্পদ ও মূলধন সংরক্ষণ করা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোম্পানির পক্ষে সম্ভবপর হচ্ছে না। এবং তার দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করা দুরূহ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। এ অবস্থায় অচিরেই ব্যাংক কোম্পানিটিকে আরও সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে উপনীত করতে পারে, তাহলে এই ব্যাংক কোম্পানি অবিলম্বে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করবে।
ব্যাংক কোম্পানির ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার আদেশ আইনে বলা হয়েছে, ‘(১) ধারা ৫৯-এর অধীন স্থায়ী কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যাংক-কোম্পানির সামগ্রিক আর্থিক এবং পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাগত অবস্থা বিবেচনা করে আপাতত বলবৎ করবে। অন্য কোনো আইন বা কোনো চুক্তি বা অন্য দলিলে যাই থাকুক, জনস্বার্থে বা আমানতকারীদের স্বার্থে, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের পরিচালক পর্ষদের অনুমোদন গ্রহণপূর্বক সংশ্লিষ্ট ব্যাংক-কোম্পানির ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার আদেশ প্রদান করার লক্ষ্যে, অনধিক ছয় মাস সময়ের জন্য সেইরূপ আদেশ প্রদান করতে পারবে। তবে শর্ত থাকে, বাংলাদেশ ব্যাংক সেই মেয়াদ অনধিক আরও ছয় মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারবে।’
জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ৫৯টি তফসিলি ব্যাংক কার্যক্রমে আছে। নতুন নতুন ব্যাংকও এ খাতে যুক্ত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এ সংখ্যাকে বেশি বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সিংহভাগ ব্যাংকের সম্পদ ১৫ হাজার কোটি টাকার নিচে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ হাজার কোটি টাকারও কম। এ অবস্থায় পরিচালন ব্যয় নির্বাহেই শেষ হয়ে যাচ্ছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের ভারও বইতে হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এ খাতকে একীভূতকরণের পথেই হাঁটতে হবে।
এর আগে ২০০৯ সালে সরকারি খাতের দুটি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা ও বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) গঠিত হয়। এরপর দেশের কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ পথে হাঁটেনি। তবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে একীভূত করার প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত করা ভালো উদ্যোগ। এ দাবি আমাদের দীর্ঘদিনের। আইন সংশোধনের পাশাপাশি এটি করতে যেন কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন