অনেকটা অগোচর আর বেশ খানিকটা অবহেলার মাঝেও বেড়ে উঠেছে দেশের সিরামিক খাত। উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায় এ পণ্যের আমদানি কমছে, বাড়ছে রপ্তানি। প্রতি বছরই এ খাতে নতুন বিনিয়োগ আসছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিশ্ববাজার দখলে নিয়েছে বাংলাদেশে তৈরি বিভিন্ন সিরামিক পণ্য। সব মিলিয়ে সিরামিক খাতে শক্ত ভিত তৈরি করে নিচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সিরামিক শিল্পে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিরামিক শিল্প বাংলাদেশের একটি ক্রমবর্ধমান উত্পাদন খাত। প্রথম সিরামিক শিল্প কারাখানা ১৯৫০এর দশকে স্থাপিত হয় এবং সেসময় থেকেই এই শিল্পের যাত্রা শুরু। সিরামিক টেবিলওয়্যার, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার- তিনটি শিল্পকে একত্রে সিরামিক খাত বলা হয়।
এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, সিরামিকশিল্পের প্রসারের সঙ্গে বাড়ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। দেশে সিরামিক পণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজার এখন পাঁচ হাজার কোটি টাকার। আবার খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মরত আছেন প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। প্রতিবছর এ শিল্পের প্রসারের সঙ্গে বাড়ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ।
সিরামিকশিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ সিরামিক ওয়্যারস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিডব্লিউএমএ) হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন সিরামিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫০। এর মধ্যে সিরামিক টেবিলওয়্যার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ১৪টি, টাইলস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ২০টি ও স্যানিটারি উৎপাদনকারী ১৬টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে সরাসরি কর্মরত আছেন ৪০ হাজারের বেশি মানুষ।
সংগঠনের সভাপতি সংসদ সদস্য মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, প্রায় ৫০টি দেশে বাংলাদেশী সিরামিক পণ্য রপ্তানি করা হয়। সামনে এই সংখ্যাকে আমরা আরও বাড়াতে চাই।
উদ্যোক্তারা বলেন, সিরামিক খাতে এখন বছরে প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৫ শতাংশ। প্রতি বছর প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার রাজস্ব দেন সিরামিক শিল্প মালিকরা।
তৈজসপত্র, স্যানিটারি পণ্য আর টাইলস এই তিন ধরনের পণ্য সিরামিক কারখানায় উৎপাদিত হয়। টাইলস, বেসিন, কমোড, কিচেন ওয়্যার, স্যানেটারি ওয়্যার, টেবিল ওয়্যার, মাটির জার, কলস, ফুলের টব, মটকা, টেবিল ওয়্যার, স্যানেটারি ওয়্যার, গার্ডেন পট, ভেজ, কিচেন ওয়্যার, ডিনার সেট, টি সেট, কফি মগ, প্লেট, বাটি থেকে শুরু করে গৃহস্থলীর বিভিন্ন জিনিসপত্র সিরামিক দ্বারা তৈরি করা হচ্ছে। শাইনপুকুর, মুন্নু, বেঙ্গল ফাইন, স্টান্ডার্ড, পিপলস এবং ন্যাশনাল সিরামিক কারখানা বাংলাদেশের সিরামিক তৈজসপত্রের উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। আবার আরএকে, ফুয়াং, চায়না-বাংলা, ফার, মধুমতি, এটিআই, সানফ্লাওয়ার, গ্রেট ওয়াল, ঢাকা-সাংহাই এবং মীর কোম্পানি টাইলস ও স্যানেটারি পণ্য উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
বিসিএমইএ তথ্যমতে, তৈজসপত্র উৎপাদনকারী ২৬ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ কোটি পিস। তারাই তৈজসপত্রের দেশীয় চাহিদার ৮৮.৫৫ শতাংশ পূরণ করে। ২৬টি টাইলস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দেশীয় চাহিদার ৭২.২৯ শতাংশ জোগান দেয়। তাদের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১২ কোটি বর্গমিটার টাইলস। স্যানিটারি পণ্যের দেশীয় চাহিদার ৮৩.৪৩ শতাংশ পূরণ করছে ১৬টি স্যানিটারি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বাকিটা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়।
বর্তমানে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিসহ বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে বাংলাদেশের সিরামিক পণ্যসামগ্রী রপ্তানি হচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চার কোটি ১৮ লাখ কোটি ডলার বা ৩৩৮ কোটি টাকার সিরামিক পণ্য রপ্তানি করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এই আয় আগের অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১৪ শতাংশ বেশি। সিরামিক পণ্যের মধ্যে তৈজসপত্র বেশি রপ্তানি হচ্ছে।
সিরামিক পণ্য রপ্তানিতে নেতৃত্ব দেয় চীন। তবে শ্রমিকের খরচ বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে চীনের রপ্তানি কমছে। চীনের বাজার সংকুচিত হওয়ায় বাংলাদেশের ক্রয়াদেশ বাড়ছে।
জানা গেছে, দেশে সিরামিক খাতের গোড়াপত্তন হয় ষাটের দশকে। প্রথমে এমসিআই ও ন্যাশনাল সিরামিক কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ঢাকা সিরামিক ও তাজমা সিরামিক কারখানা হয়। ১৯৬২ সালে যাত্রা শুরু করে পাকিস্তান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ। স্বাধীনতার পর থেকে সেটি পিপলস সিরামিক নামে পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) আওতায় মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্যুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারিওয়্যার ফ্যাক্টরি (বিআইএসএফ) হয়। বেসরকারি খাতে প্রথম কারখানা মুন্নু সিরামিক হয় ১৯৮৫ সালে। পরে অনেক উদ্যোক্তা সিরামিক খাতে বিনিয়োগ করেন।
উন্নতমানের সিরামিক পণ্য উৎপাদনে মুন্নু, শাইনপুকুর, পিপলস, ফার, প্রতীক, আরএকে, সিবিসি, স্ট্যান্ডার্ড, আবুল খায়ের, ইউরো বাংলা, চারু, মধুমতি, স্টার, প্যারাগনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন