সম্পদের মূল্যমান নিয়ে ব্যাংকগুলোর উদ্বেগ ও আঁটসাঁট তারল্য পরিস্থিতি সত্ত্বেও আগামী এক-দেড় বছর (১২-১৮ মাস) স্থিতিশীল থাকবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। এর মূল কারণ খাতটিতে বিরাজমান সুস্থ পরিচালনার পরিবেশ। গতকাল প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে এমন পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি’স। ওই সময়ের জন্য বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ঋণমান বিএথ্রি নির্ধারণ করেছে সংস্থাটি।
মুডি’সের অ্যাসোসিয়েট অ্যানালিস্ট কোমারেসান সুব্রামানিয়াম বলেন, সম্পদের মান নিয়ে উদ্বেগ ব্যাংকগুলোর জন্য এখনো ঋণমানের দুর্বল জায়গা হিসেবে চিহ্নিত। বিশেষত বড় অংকের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ কেলেঙ্কারির প্রভাবে আগামী এক-দেড় বছর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ ঝুঁকির আশঙ্কা বেশি থাকবে। ব্যাংকের তারল্য স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকলেও ঋণের পরিবর্তে সঞ্চয়ের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতির জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ব্যাংক পরিচালনার পরিবেশের বিষয়ে মুডি’স বলছে, বাংলাদেশ উচ্চ ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। বেসরকারি খাতে বিপুল বিনিয়োগ ও ভোগের প্রবৃদ্ধি এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। ২০১৪-১৬ সময়ে বেসরকারি খাতে গড়ে ১৬ শতাংশ হারে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ সময়ে ব্যক্তিখাতে ভোগের প্রবৃদ্ধিও উল্লেখ করার মতো ১১ শতাংশ। আয়ের বৃদ্ধিতে ব্যক্তিখাতে ভোগের এ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
‘ব্যাংকিং সিস্টেম আউটলুক-বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে মুডি’স আরো উল্লেখ করেছে, ব্যাংকের ঋণপ্রবৃদ্ধিও ইতিবাচক। চলতি বছরের ৩০ মার্চ পর্যন্ত এক বছরে ব্যাংকগুলোর ঋণপ্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ শতাংশ।
মুডি’সের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সিনিয়র ক্রেডিট অফিসার শ্রীকান্ত ভাদ্লামনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে একই গতিতে চলছে ঋণের প্রবৃদ্ধিও। ঋণের এ প্রবৃদ্ধি প্রকাশ পাচ্ছে ১ দশমিক ১-এর গুণিতক হিসেবে। আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ ব্যাংকগুলো আরো ঋণপ্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে আশা করা যায়।
সামগ্রিক ঋণের প্রবৃদ্ধিতে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে শিল্প খাতে দেয়া মেয়াদি ঋণগুলো। চলমান বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এসব ঋণ দেয়া হচ্ছে। নির্মাণ ও অবকাঠামো খাতে ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এটিকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করে ঋণের এ প্রবাহে ধারাবাহিকতার আশা করছে মুডি’স।
ব্যাংকিং খাতে ব্যক্তিগত ঋণের প্রবৃদ্ধিও এখন ঊর্ধ্বমুখী। মুডি’স বলছে, ব্যক্তিগত ঋণের প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে। কারণ অনেক ব্যাংকই এ খাতে ঋণ দিতে এগিয়ে আসছে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে মুডি’সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী এক-দেড় বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতে সম্পদের মানের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। এটি প্রকট হবে বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেই। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে সামগ্রিক অকার্যকর ঋণের (এনপিএল) হার ছিল ১০ দশমিক ১ শতাংশ, যা দুর্বল অবস্থারই প্রকাশ। আগের বছরের চেয়ে পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছে এক্ষেত্রে।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অকার্যকর ঋণের পরিমাণ মোট ঋণের সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ। এসব অকার্যকর ঋণের বোঝার কারণে ভুগতে হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে। গত জুন শেষে তাদের অকার্যকর ঋণের অনুপাত দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এখনো তাদের দেয়া ঋণের বড় একটা অংশই নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহকের কাছে। ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম হলো ঋণ নিবিড়তা। মূলত এ ঋণের সিংহভাগ রয়েছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। ব্যাংকগুলোও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ প্রদানে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এটিকে ব্যাংকের ঋণমানের ক্ষেত্রে কাঠামোগত বড় ঝুঁকি বলে মনে করছে মুডি’স।
সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতির ঘটনা, আগ্রাসী ঋণপ্রবৃদ্ধি ও নির্দিষ্ট কিছু খাতে দুর্বলতার কারণে এ অনুপাত বেড়েছে। যদিও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ পরিবেশের সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যেও ঋণপ্রবৃদ্ধি ও সম্পদের মানের ধারা স্থিতিশীল রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে মুডি’স।
বিশ্লেষণে মুডি’স বলছে, ব্যাংকগুলোর মূলধনে সামান্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। দ্রুত ঋণপ্রবৃদ্ধি ও মুনাফার হার কমে যাওয়ায় এ ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত মূলধন থাকলেও এক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততার হার দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশ।
গ্রাহকের সঞ্চয়ের ওপর ব্যাংকগুলোর নির্ভরতা বাড়ছে। ফলে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় ঋণ ও আমানতের অনুপাত বড় হচ্ছে। তিন বছর ধরে আমানতের প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়েছে ঋণের প্রবৃদ্ধি।
কিছু কিছু পুনঃতফসিলীকৃত ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ায় আগামী এক-দেড় বছর ঋণব্যয় বেশি থাকবে বলে ধারণা করছে মুডি’স। এজন্য সংশ্লিষ্ট অংকের অর্থ প্রভিশনিংয়ের প্রয়োজন রয়েছে।
ব্যাংকগুলোর নিট ইন্টারেস্ট মার্জিন ও প্রকৃত মুনাফা স্থিতিশীল থাকবে। এ সময়ে ঋণের উচ্চ চাহিদার বিপরীতে সুদ বাবদ আয়ও বাড়বে তাদের।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন