বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর নজর এখন হাইপারসনিক মিসাইল বা ক্ষেপণাস্ত্রের দিকে। সবশেষ, মধ্যবর্তী পাল্লার একটি নতুন কঠিন-জ্বালানিতে চলা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর কথা জানিয়েছে উত্তর কোরিয়া। শুধু উত্তর কোরিয়া নয়, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ইরানসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ সাম্প্রতিক বছরে এই হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরি করছে।
কিন্তু কী আছে এই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রে? হাইপারসনিক অস্ত্রে এখন পর্যন্ত এগিয়ে কোন দেশ?
হাইপারসনিক মিসাইল কী?
হাইপারসনিক মিসাইল হলো অত্যন্ত দ্রুতগতির একটি ক্ষেপণাস্ত্র, যা শব্দের চেয়ে পাঁচগুণ গতিতে ছুটে চলতে সক্ষম। অর্থাৎ ঘণ্টায় ৬ হাজার ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সক্ষম এই ক্ষেপণাস্ত্র। কিছু ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এরইমধ্যেই এই গতিতে ছুটতে সক্ষম, তবে হাইপারসনিকের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো বায়ুমণ্ডলে এলোমেলো ছুটোছুটি করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে এটির আঘাত হানার সক্ষমতা।
কীভাবে কাজ করে হাইপারসনিক মিসাইল?
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সাধারণত ওয়ারহেড উৎক্ষেপণ করা হয়। যেটি মিসাইলের মাথায় থাকে। ঘণ্টায় ৬ হাজার ২০০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চললেও, এটি প্রায়ই তুলনামূলকভাবে কম উচ্চতায় চালিত হয়। নামে হাইপারসনিক হলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, হাইপারসনিক অস্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য গতি নয় বরং হামলার অনন্য সক্ষমতা।
২০২১ সালে উত্তর কোরিয়ার প্রথম হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষায় একটি গ্লাইডার-আকৃতির ওয়ারহেড দেখানো হয়েছিল। আবার যখন ২০২২ সালে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হয় তখন তা বিশ্লেষণ করে দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞরা জানান, তাদের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রে ব্যালিস্টিক মিসাইলের ওয়ারহেড ব্যবহার করা হয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, সবশেষ পিয়ংইয়ং যে পরীক্ষা করেছে তার লক্ষ্য ছিল নতুন মাল্টি-স্টেজ, হাই-থ্রাস্ট সলিড-ফুয়েল ইঞ্জিন এবং মধ্যবর্তী-রেঞ্জের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেডের নির্ভরযোগ্যতা পরীক্ষা করা। আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিপরীতে ব্যালিস্টিক ট্র্যাজেক্টোরিতে পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করে, যা মহাকাশে ভ্রমণ করে কিন্তু কখনোই কক্ষপথে পৌঁছায় না।
হাইপারসনিক মিসাইলের দৌড়ে এগিয়ে কে?
২০২১ সালে মহাকাশে হাইপারসনিক গ্লাইড বহনকারী একটি রকেট উৎক্ষেপণ করে চীন। লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগে বিশ্বকে প্রদক্ষিণ করে এটি। কয়েক মাইলের জন্য এটি লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাতে পারেনি। সে বছরে অর্থাৎ ২০২১ সালের শুরুর দিকে রাশিয়া হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রে সফলতার দেখা পায়। দেশটি সফলভাবে হাইপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র জিরকনের পরীক্ষা চালায়। যেটিকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার একটি নতুন প্রজন্মের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন।
শুধু তাই নয়, প্রথমবারের মতো সাবমেরিন এবং একটি ফ্রিগেট থেকে অস্ত্র পরীক্ষা করে মস্কো। আবার যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে জানায়, বায়ুচালিত হাইপারসনিক অস্ত্রের পরীক্ষা করেছে ওয়াশিংটন। যেটির অর্থ, তাদের হাইপারসনিক মিসাইল ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে নিজের ফ্লাইট বজায় রাখে। ২০১৩ সালের পর প্রথমবারের মতো এ জাতীয় অস্ত্রের সফল পরীক্ষা এটি তাদের।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র ইরান ২০২৩ সালের জুনে তাদের প্রথম অত্যাধুনিক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র উন্মোচনের কথা জানায়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি প্রথমবারের মতো দেশটির প্রতিরক্ষা খাতে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র সংযুক্ত করার দাবি করে। মূলত আইআরজিসির অ্যারোস্পেস ফোর্স এ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘ফাত্তাহ’ বা বিজয়ী।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, ইরানের তৈরি এই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ১৪০০ কিলোমিটার। এটি সব ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম বলেও দাবি করা হয়। যেখানে আরও বলা হয়, ক্ষেপণাস্ত্রটি শব্দের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি দ্রুত ছুটতে পারে। আর এই গতির কারণেই ফাত্তাহ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের অন্যতম প্রধান ক্ষমতা। ফাত্তাহ মিসাইলেও কঠিন জ্বালানি ব্যবহার করা হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধে হাইপারসনিক মিসাইল
চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে এরইমধ্যে হাইপারসনিক কিনজাল মিসাইল ব্যবহার করেছে রুশ বাহিনী। গেল ৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে চালানো হামলায় বেশ কয়েকজন সেনা হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। আর এটিই যুদ্ধে রাশিয়ার প্রথম হাইপারসনিক মিসাইল হামলার ঘটনা বলে জানিয়েছে গণমাধ্যম।
উত্তর কোরিয়া কী চায়?
আবারও উত্তর কোরিয়া প্রসঙ্গে ফেরা যাক। হাইপারসনিক মিসাইল নিয়ে উত্তর কোরিয়ার লক্ষ্য আসলে কী? ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দেশটির ক্ষমতাসীন ওয়ার্কার্স পার্টির বৈঠকে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন সলিড-ফুয়েল চালিত আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং একটি পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরির পাশাপাশি সামরিক শক্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে পাঁচ বছরের পরিকল্পনার অধীনে পাঁচটি প্রধান কাজের মধ্যে হাইপারসনিক অস্ত্র অর্জনে বেশি গুরুত্বারোপ করেন।
এরপর ওই বছরই অর্থাৎ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করে পিয়ংইয়ং। সে সময় এটিকে ‘কৌশলগত অস্ত্র’ বলে অভিহিত করেন তারা। বলা হয়, উত্তর কোরিয়ার প্রতিরক্ষা ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার জন্য এটি ডিজাইন করা হয়েছে। যদিও প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়ার বেশ কয়েকজন বিশ্লেষক ওই পরীক্ষাকে ‘ব্যর্থ প্রচেষ্টা’ বলে দাবি করেন।
তবে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে আবার সিউলের কর্মকর্তারাই এক প্রতিবেদনে জানান, উত্তর কোরিয়া আরেকটি সম্ভাব্য হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে যা অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় শব্দের চেয়ে ১০ গুণ বা ঘণ্টায় ১২ হাজার ৩৪৮ কিলোমিটার গতিতে ওড়ে। এ বছর উত্তর কোরিয়ার সবশেষ উৎক্ষেপণ করা হাইপারসনিক মিসাইলটি কঠিন জ্বালানি চালিত বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র কম সময়ে ও কম প্রস্তুতি নিয়ে দ্রুততম সময়ে উৎক্ষেপণ সম্ভব বলেও জানান তারা।
বলে রাখা ভালো, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম যখন রাশিয়া সফর করেন, তখনই তিনি মস্কোর বিভিন্ন উন্নত অস্ত্রের পাশাপাশি হাইপারসনিক মিসাইলও পরিদর্শন করেন।
হাইপারসনিক মিসাইল গুরুত্বপূর্ণ কেন?
ছোট-বড় সব দেশই এখন হাইপারসনিক অস্ত্র অর্জনে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ, সংঘাত ও নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি অস্ত্র প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে ছোট এশীয় দেশগুলোও বড় সামরিক শক্তির পাশাপাশি উন্নত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বিকাশের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এর মধ্যে কোরিয়ার কথাই বলা যায়। বিশেষ করে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে চলার পাশাপাশি গুয়ামে থাকা মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলায় সক্ষম দূরপাল্লার হাইপারসনিক মিসাইল বানাতেও তোড়জোড় শুরু করেছে পিয়ংইয়ং।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন