জাপানের মন্ত্রিসভা পঞ্চম প্রজন্মের চেয়েও আধুনিক যুদ্ধবিমান রপ্তানিকারী দেশের তালিকায় নাম লেখানোর সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাপূর্ণ স্মৃতির প্রেক্ষাপটের ওপর দাঁড়িয়ে গৃহীত ‘সংবিধানসম্মত’ শান্তিবাদী ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলে গতকাল মঙ্গলবার জাপান উল্টোদিকে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। অবশ্য জাপান যে নিজের এই ভাবমূর্তি পরিহার করতে উদগ্রীব তা প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিসিদা থেকে শুরু করে আগের সরকারগুলোর কর্মকাণ্ডেও ফুটে উঠেছিল।
জাপান নিজের শান্তিবাদী ভাবমূর্তি রক্ষা করবে নাকি নীতি বলবৎ রাখবে না, দীর্ঘদিন ধরে দেশটির রাজনৈতিক পরিসরে বড় একটি বিতর্কের ব্যাপার। মন্ত্রিসভা সর্বশেষ এই ভাবমূর্তি পরিত্যাগের চূড়ান্ত ঘোষণাই দিল। এর মাধ্যমে জাপান আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাণিজ্যের খাতায় নাম তুলতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্য ও ইতালির সঙ্গে যুদ্ধবিমান নির্মাণের পথে এগিয়ে গেল জাপান। এ ছাড়া অস্ত্রের বৈশ্বিক বাজারে প্রতিরক্ষা জায়ান্ট হওয়াও জাপানের এখনকার লক্ষ্য।
বহির্বিশ্বে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানির ক্ষেত্রে যে ‘প্রতিবন্ধক’ নির্দেশনা ছিল তা পুনর্মূল্যায়নের পাশাপাশি যুদ্ধবিমান বিক্রির অনুমোদন দেওয়া হয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে। তবে দেশটি বলছে, তারা সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে উৎপাদিত প্রাণঘাতী অস্ত্রের কোনো বাণিজ্য করবে না এবং এমনটা করতে চাইলে মন্ত্রিসভার অনুমোদন লাগবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান শান্তিবাদী সংবিধান গ্রহণ করার কারণে প্রাণঘাতী কোনো মারণাস্ত্র রপ্তানিতে জড়িত ছিল না। কিন্তু রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়ার সম্ভাব্য ঝুঁকির কথা বিবেচনায় নিয়ে জাপানি রাজনীতিকরা বিষয়টিতে পরিবর্তন আনতে চাইছিলেন। ২০১৪ সালে এসে প্রথমবারের মতো জাপান অ-প্রাণঘাতী (নন-লিথাল) অস্ত্র রপ্তানি শুরু করে। গত ডিসেম্বরে দেশটি প্রথমবারের মতো ৮০টি প্রাণঘাতী অস্ত্র ও সরঞ্জাম বিক্রির অনুমোদন দেয়। মার্কিন প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রের সংস্করণ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ করছে জাপান। ইউক্রেন যুদ্ধে ওয়াশিংটন অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সহায়তা করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এসব অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে জাপান।
মন্ত্রিসভার অনুমোদনক্রমে জাপান সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে। মার্কিন সংস্করণের এফ-২ যুদ্ধবিমানের আদলে ইতালি ও যুক্তরাজ্যের সহযোগিতায় টোকিও এটি নির্মাণ করবে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য ও ইতালির সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত ইউরোফাইটার টাইফুনের মতো যুদ্ধবিমানও তৈরি করবে জাপান।
প্রাণঘাতী প্রতিরক্ষা সামগ্রী রপ্তানির প্রশ্নে জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিসিদা তার সরকারের অংশীদার বৌদ্ধ-সমর্থিত কোমেইটো পার্টিসহ আরও নানা দিক থেকে বাধা পাচ্ছিলেন। তবে সব সমালোচনাকে সামাল দিতে পেরেছে কিসিদার সরকার। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের দিক থেকে নীতি বদলের জন্য কয়েকবার আহ্বান এসেছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী এপ্রিলে কিসিদা ওয়াশিংটন সফর করবেন। প্রতিরক্ষা শিল্পের এক বড় জোগানদাতা হিসেবে নাম লেখাতে জাপানের অগ্রগতির পর্যালোচনা হতে পারে ওই সফরে। বিশেষ করে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিং ও মস্কোর চ্যালেঞ্জ রুখতে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ লক্ষ্য রয়েছে।
কিসিদা সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে বিরোধী আইনপ্রণেতা ও শান্তিবাদী আন্দোলনকর্মী বলছেন, সরকার বড় ধরনের নীতি বদল করল জনগণের কোনো মতামত ছাড়াই। জাপানের জনমত এখনো বিষয়টি নিয়ে দ্বিধান্বিত।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর ইঙ্গিত, আসন্ন ওয়াশিংটন সফরে জাপানি প্রধানমন্ত্রী প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন এবং পণ্যের বৈচিত্র্য আনয়নের জন্য আলোচনা করতে পারেন। নতুন নতুন যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন করতে জাপান ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। জাপানি নীতির এই বাকবদল ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে জাপানের অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব ধরে রাখতে ভূমিকা রাখবে। যুদ্ধবিমানের বাজার রয়েছে এমন ১৫টি দেশের সঙ্গে জাপানের প্রতিরক্ষা অংশীদারি রয়েছে। জাপানি প্রতিরক্ষা পণ্যের গন্তব্য হতে পারে এসব দেশ। যেমন- ভারত, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন