ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিহারের চিরাইলা গ্রামের নুরি মসজিদের আশপাশ এলাকায় খরা ও বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব কিভাবে সেখানকার অধিবাসীদের বাস্তুচ্যুত করেছে সেই গল্প উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। ৩৪ বছর আগে বাঁধ নির্মাণের পর শৈশবের স্মৃতিবিজরিত মসজিদসহ পুরো গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। গত সেপ্টেম্বরে পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার পর এবারই প্রথম ভেসে ওঠে মসজিদটি। আলজাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ
ভারতের বিহার অঞ্চলের চিরাইলা গ্রামের নুরি মসজিদ ঘিরেই বেড়ে উঠেছেন ৫০ বছর বয়সী মুহাম্মদ আফতাব হোসাইন।
বিজ্ঞাপন
শৈশবে অন্যদের মতোই ক্রিম রঙের এ মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেন তিনি। মসজিদ খালি থাকলে গ্রামের শিশুদের সঙ্গে তিনিও গম্বুজ আকৃতির এ মসজিদে চিৎকার করতেন। চিৎকারের প্রতিধ্বনি তাদের আনন্দকে আরো বাড়িয়ে দিত। কিন্তু ৩৪ বছর আগে বাঁধ নির্মাণের পর শৈশবের স্মৃতিবিজরিত মসজিদসহ পুরো গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। এরপর পাশের হারদিয়া গ্রামে গিয়ে বসতি গড়েন সবাই।
কিন্তু এ বছরের উচ্চ তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের অভাবে পানির স্তর নেমে যায়। গত সেপ্টেম্বরে পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার পর এবারই প্রথম ভেসে উঠে মসজিদটি। এরপর থেকেই শুরু হয় কৌতূহলী পর্যটকদের ভিড়। পাটনা থেকে দক্ষিণে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার দূরত্বে ফুলওয়ারিয়া বাঁধ এখন সবার গন্তব্য। প্রতিদিন দর্শনার্থীরা তা দেখতে আসে। প্রথমদিকে মসজিদের মূল স্থাপনা দেখতে কাদা মাড়িয়ে অনেকে এর মূল ভবনে আসে। অনেকে তা পরিষ্কার করার চেষ্টা করে। একজন মসজিদের বাইরে আজানও দেয়। তবে ভেসে ওঠার পর বৃষ্টির কারণে আবারও তাতে পানির স্তর অন্তত দুই মিটার (সাত ফুট) বৃদ্ধি পায়। ফলে মসজিদের মূল কাঠামো ফের পানিতে ঢাকা পড়ছে।
চিরাইলা গ্রামের সাবেক বাসিন্দা আফতাব হোসাইন বলেন, ‘আমরা জানতাম যে মসজিদটি এখানেই আছে। বাঁধ নির্মাণের পরই মসজিদটি পুরোপুরি ডুবে যায়। মসজিদটি নিয়ে এখন সবার মধ্যে বেশ আগ্রহ। কিন্তু মসজিদটি আমাদের গ্রামের হারানো জীবনের কথাও মনে করিয়ে দেয়। ’ অনেক দর্শনার্থীর কাছে তা অস্বাভাবিক দৃশ্য মনে হলেও হোসাইন বলেন, ‘আমাদের কাছে মসজিদটি অলৌকিক কিছু নয়। ’
চিরাইলার আরেক বাসিন্দা বিলাল আহমাদ জানান, ‘পুরনো মসজিদের আবির্ভাব গ্রামবাসীর হারিয়ে যাওয়া জীবনধারা ও সময়কে স্মরণ করিয়ে দেয়। গ্রামের সবার স্মৃতির শিকড় মসজিদের সঙ্গে বাঁধা। আমরা এই গ্রামেও একই ধরনের মসজিদ তৈরি করতে চেয়েছি; কিন্তু সেই বিস্ময় আবার তৈরি করা সম্ভব নয়। ’
জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, মসজিদ ভেসে ওঠার বিষয়টি ভারতের দরিদ্রতম রাজ্যের ভয়াবহ খরা পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। হোসেনের মতো অনেকের জন্য তা বাস্তুচ্যুত হওয়ার দুঃসহ স্মৃতির বাহক। কারণ আশির দশকের মধ্যভাগে চিরাইলাসহ ডজনখানেক গ্রামের বাসিন্দারা তাদের বাড়ি-ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।
নিচু পাহাড়ে ঘেরা চিরাইলা গ্রাম ছিল খুবই শান্ত। সেখানে মুসলিম ও হিন্দ একসঙ্গে বসবাস করত। পাশের স্রোতবাহী খাল থেকে পানি এনে নামাজের আগে অজু করতেন মুসলিমরা। গ্রামবাসীর কারো কারো নিজস্ব জমি ছিল। আর অধিকাংশের আয়ের উৎস ছিল চাষাবাদ। বেশিরভাগ সময় ভুট্টা ও ধানের চাষ হত। নিজ গ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে আফতাব হোসাইন এক পর্যায়ে গর্বভরে বলেন, ‘এটা ছিল কাশ্মীরের মতো’।
শ্রমিক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে হুসাইন বলেন, যে রাজমিস্ত্রিরা এর নকশা করেছিলেন, তাঁরা সুরকি চুনার (চুন মিশ্রিত পোড়া মাটির ইট থেকে তৈরি) কাজ জানতেন। ওগুলো দিয়েই মসজিদটি মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী করে তৈরি করা হয়। কাজটি বেশ শ্রমসাধ্য ও দক্ষতার পরিচয়ও বটে। হোসেনসহ অনেকের বিশ্বাস, ১৬ থেকে ১৯ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম রাজবংশ মোগলদের ভারত শাসনের পর মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। অবশ্য মসজিদের তিনটি গম্বুজ, আটটি মিনার ও খিলান মোগল আমলে নির্মিত ভারতের বিভিন্ন ভবনের সঙ্গে মিল রয়েছে।
দুঃসহ স্মৃতিচারণা করে হোসাইন বলেন, ‘চিরাইলা গ্রাম থেকে হারদিয়ার দূরত্ব সাত কিলোমিটার। ১৯৮৫ সালে চিরাইলাসহ ডজনখানেক গ্রামের অধিবাসীকে হারদিয়ায় চলে যেতে বাধ্য করা হয়। আমাদের কেউ যেতে না চাইলেও এক মাসের মধ্যে সবাইকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এমনকি কর্তৃপক্ষ হুমকি দেয় যে গ্রাম না ছাড়লে বন্যায় পুরো সবাই তলিয়ে যাবে। ’ একসময় পুরো গ্রাম ভেঙে ফেলা হয়। কিন্তু পবিত্র হিসেবে মসজিদটি অক্ষত রাখা হয়।
হারদিয়া গিয়ে বাস্তুচ্যুত সবাই একসঙ্গে বসবাস করায় নিজেদের পাড়াকে হারানো গ্রামের নামে ‘চিরাইলা’ নাম দেওয়া হয়। এমনকি নতুন এলাকায় এসে নতুন মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পুরোনো মসজিদের স্মরণে নতুনটির নামও নুরি মসজিদ রাখা হয়। কিন্তু সবাই হতদরিদ্র হওয়ায় অল্প অল্প অনুদান সংগ্রহ করে মসজিদের কাজ চলছে। এখানে এসে গ্রামবাসীকে নতুন করে জীবিকা নির্বাহের সংগ্রাম শুরু করতে হয়। সরকার এক খণ্ড জমি ও সামান্য অর্থ সবাইকে দিয়েছে। এখানে কেউ সুখী নয়,
দীর্ঘদিন পানির নিচে থাকায় মসজিদের অনেক জায়গায় প্লাস্টার উঠে যায় এবং তাতে শৈবালের আবরণ দেখা যায়। তা ছাড়া মিনারের কোণে ও ছাদে ফাটল রয়েছে। মসজিদের কাছে এলে ভবন থেকে একটা মৃদু গন্ধ ভেসে আসে। গত অক্টোবরের এক রৌদ্রোজ্জ্বল বিকাল। নদীর তীর ঘেঁষে ১২টি কাঠের নৌকা নিয়ে অপেক্ষায় স্থানীয় মৎস্যজীবীরা। মসজিদ দেখতে আসা দর্শকদের তারা প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মসজিদে আনা-নেওয়া করেন।
ফুলওয়ারিয়া পাশে থাকা কৃষক ৫১ বছর বয়সী গোরায়লাল সিং বলেন, ‘কয়েক দশক ধরে আমি জেলে হিসেবে বাঁধের চারপাশে কাজ করছি। ৩০ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম আমি মসজিদটি পুরোপুরি দৃশ্যমান দেখেছি। মসজিদটি আমার জন্য অতিরিক্ত উপার্জনের পথ খুলে দিয়েছে। মাছ ধরার পাশাপাশি আমি পর্যটকদের নৌকা ভ্রমণের জন্য নিয়ে যাই। ’
বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল কৃষকদের জন্য পানির স্তর নেমে মসজিদ ভেসে উঠার বিষয়টি আরেকটি বার্তা দেয়। ভারতের সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদনকারী এ অঞ্চল অনিয়মিত ও স্বল্প বৃষ্টিপাতের সম্মুখীন হচ্ছে। তার মাসে এখানে পর্যাপ্ত পানি নেই। ফলে এর ওপর নির্ভরশীল কৃষকদের জন্য বিষয়টি মোটেও সুখকর নয়।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ঘটনা পুরোপুরি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খরার সঙ্গে যুক্ত। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার মাসে এখানে ৮৪ শতাংশ বৃষ্টিপাত হয়। অথচ জুলাই মাসে খুবই শুষ্ক পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল যা মূলত ধান বপনের সময়। মৌসুমের এমন পরিবর্তন খুবই বিরল বলে জানান বিহারের রাজেন্দ্র প্রসাদ কেন্দ্রীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ অন ক্লাইমেট চেঞ্জের বিজ্ঞানী আবদুস সাত্তার।
আবদুস সাত্তার জানান, বিহারের ৩৯টি জেলার মধ্যে ১১টি খরা-বিধ্বস্ত জেলা। সরকারি পরিসংখ্যান মতে এ বছর রাজ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৯ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। যেহেতু রাজ্যের অর্ধেক জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে, তাই মানুষের জন্য একটি বড় ধাক্কা। সেচ ও জলজ চাষের জন্য তৈরি বাঁধের নিম্ন স্তর পানি সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ দেখায়। ফলে বাড়ছে শুষ্কতা এবং বাঁধ, পুকুর ও অন্যান্য পানির উত্সগুলো পানির স্তর প্রভাবিত হচ্ছে।
এদিকে বিহারের ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের জলবায়ু বিজ্ঞানী আনন্দ শঙ্কর জানান, গত ১২০ বছরের মধ্যে জুলাই মাস ছিল বিহার এলাকায় সবচেয়ে শুষ্ক সময়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন মৌসুমি শুষ্কতা বাড়ছে এবং বৃষ্টিপাত হ্রাস পাচ্ছে। এই বছর উত্তর প্রদেশ ও ঝাড়খন্ডের মতো ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোতেও এর প্রভাব পড়ে। অক্টোবরের মধ্যভাগে রাজ্য সরকার খরায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৮ হাজার গ্রামের প্রতিটি পরিবারের জন্য তিন হাজার পাঁচ শ টাকা (৪২ ডলার) ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে।
এ বছরের শুরুতে জাতিসংঘের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতীয় জনসংখ্যার অন্তত ৪০ শতাংশ পানির অভাবের মুখোমুখি হবে। মানুষ পুরোনো গ্রামের কথা খুবই স্মরণ করে বলে ভরাক্রান্ত কণ্ঠে জানান হোসাইন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন