পুলিশি হেফাজতে ২২ বছরের তরুণী মাহসা আমিনি নিহতের ঘটনায় গোটা ইরান টালমাটাল অবস্থা। দেশটির ৩১টি প্রদেশের মধ্যে ৩০টি প্রদেশেই রাজপথ উত্তাল রেখেছে আন্দোলনকারীরা। বিক্ষোভ দমনে নিরাপত্তা বাহিনী কঠোর হওয়ার পর আন্দোলনের তেজ আরও বেড়ে চলেছে। এদিকে ইরানের সরকার ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ রেখেছে। এর পরও চোরাগোপ্তা পথে যেটুকু খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে চলমান বিক্ষোভ ইরানের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে।
পর্যবেক্ষক মহল বলছে, এই বিক্ষোভ মূলত বহুদিনের জমে থাকা ক্ষোভের বহির্প্রকাশ। ইরানের কট্টরপন্থি সরকার এতদিন নারীদের বহুমুখী চাপের মধ্যে রেখেছে- এই বিক্ষোভ তারই জের। গতকাল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান চলমান বিক্ষোভে অংশ নেওয়া পাঁচজনের ভাষ্য প্রকাশ করেছে। তারাও বলছে, ইরানের পতন অনিবার্য...
তারা (নিরাপত্তা বাহিনী) মানুষ হত্যা করছে, তারপরও আমি বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছি না। আমি বিক্ষোভে যোগ দিয়েছি। আমার বন্ধু বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে, সে আমাকে বলছে, আমি জানি না স্বাধীনতা ও শান্তির জন্য এটি উত্তম পন্থা কিনা। কিন্তু এই প্রতিবাদে নারীর নিরাপত্তা উন্নতি হবে। এর আগের বিক্ষোভগুলোয় দেখা গেছে, প্রধানত পুরুষরা নেতৃত্ব দিয়েছে। এবারের প্রতিবাদ ভিন্ন। এবার নারীরা আন্দোলন শুরু করেছে এবং পুরুষরা এতে যোগ দিয়েছে। পুলিশ যখন নারীদের জোরপূর্বক নারীদের হিজাব পরতে বলছে, পুরুষরা তাতে প্রতিবাদ করছে। বেশির ভাগ বিক্ষোভকারীই বয়সে তরুণ, কিন্তু জ্যেষ্ঠরাও এতে সমর্থন দিচ্ছে।
ফারাহ (৩৭), এক সন্তানের জননী, দক্ষিণ ইরান
# মায়ের সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দিচ্ছে অনেকেই
আমার বিশ^বিদ্যালয়ে বিক্ষোভে আমি যোগ দিয়েছি। আজ আধা-সামরিক বাহিনীর ১০০ সদস্য বিশ^বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছে এবং কিছু শিক্ষার্থীকে আটক করে নিয়ে গেছে। আমার বন্ধুকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। সে বলেছে, সে আবারও বিক্ষোভে অংশ নেবে। এমনকি তাকে মেরে ফেললেও সে বিক্ষোভ করবে। এভাবেই আমরা বেঁচে আছি। আমরা জানি না, আমাদের বন্ধুকে আবার দেখতে পাব কিনা। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এখন বন্ধ আছে। সাধারণ মানুষ সমবেত হচ্ছে, কী হচ্ছে সেটা দেখার জন্য। নারী-পুরুষ রাস্তা দখল করে আছে। কিন্তু আমি ভাবছি নারীদের কোনো ভয় নেই।
আমার মা আমাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছেন, যেন আমি বিক্ষোভে অংশ নিই। কিন্তু পরিবারকে না জানিয়ে আমি বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলাম। গত রাতে ভয়ে অনেকেই বাড়ি ছেড়েছিলেন। কেননা রাস্তা ছিল বিপজ্জনক ও কিছুই অনুমান করা যাচ্ছিল না। অনেকেই তার মায়ের সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে। আমি পড়াশোনায় কঠোর পরিশ্রম করছি যেন একটি বৃত্তি পেয়ে এই দেশ ছাড়তে পারি। আমার মতো সবাই এটাই চায়। মানুষ এখানে থাকতে চায় না।
সোবহান (১৯), শিক্ষার্থী, তেহরান
# রাজপথে বহু মানুষ লড়াইয়ে নেমেছে
ইয়াজদ ছোট্ট ধর্মীয় শহর। গত কয়েকদিনে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে। সরকারি বাহিনী তাদের নির্যাতন করেছে, লাঠিপেটা করেছে- এমনকি গুলিও করেছে। আমি ভীত, এখন পর্যন্ত আমি বিক্ষোভে যোগ দেইনি। কিন্তু সামনের দিনগুলোয় আমি প্রতিবাদে নামব। এখানে রাস্তায় বহু মানুষ লড়াই করছে। বিশেষ করে নারী ও বালিকারা সাহসের সঙ্গে লড়ছে। কয়েক দশক থেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র তাদের (নারী) শোষণ করেছে। এখন তারা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করছে। আমি জানি, অনেক নারীই তার হিজাব ছুড়ে ফেলতে চায়। আমার বোন ও নারী বন্ধুরা এমনই বিপ্লব চায়। আমার বাবা-মা এই বিক্ষোভকে সমর্থন করছে, কিন্তু অনেকের মতো তারাও কথা বলতে ভয় পায়।
আমিন (২৯), ইয়াজদ, মধ্য ইরান
# পুরনো প্রজন্মও পরিবর্তন চায়
আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও হতাশ। আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমি শুধু চাই- আমার পরিবারকে নিরাপদ ও সুখী রাখতে। কিন্তু এই সরকার তা অসম্ভব করে তুলেছে। তারা সব ধ্বংস করে দিয়েছে- অর্থনীতি, আমদানি-রপ্তানি, সংস্কৃতি। আমার একটি কিশোর ছেলে রয়েছে এবং সে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। সে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে চায়, নিজের ইচ্ছেমতো কাপড় পরতে চায়; কিন্তু সে পারছে না। ... প্রবীণরাও এই পরিবর্তন চায় কিন্তু তারা তাদের সন্তান নিয়ে চিন্তিত।
ফারবোদ (৪৪), বিজ্ঞাপনকর্মী, তেহরান
# এই ঢেউ জাতি-মত নির্বিশেষে এক করেছে
আমি কুর্দিস্তানের বাসিন্দা, মাহসা আমিনির বাড়ি একই প্রদেশে। এই প্রতিবাদ অবশ্যই ভিন্ন। তরুণ প্রজন্ম ডরভয়হীনভাবে লড়ছে। এমনকি তারা অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে, তারপরও লড়ছে। ২০১৯ সালের বিক্ষোভে ইরানি আরব, তুর্কি ও কুর্দিদের মধ্যে একতা ছিল না। কিন্তু এখন জনতা স্লোগান তুলেছে ‘তাবরিক থেকে সানান্দাজ, তেহরান থেকে মাসহাদ। নানা ধর্ম, বর্ণের মানুষ এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে। গত সোমবার আমার শহরের সবাই নারীদের সম্মানে নিজেদের দোকান বন্ধ রেখেছে। আজকের ইরানে নাস্তিকতা নাটকীয়ভাবে বাড়ছে, যা ১০ বছর আগেও ছিল না।
সোমি (৩৮), কুর্দিস্তানের বাসন্দা, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন